বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

কাগজের বাজারে অস্থিরতা নিরসন জরুরি

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০২২, ০৯:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

কাগজের বাজারে অস্থিরতা নিরসন জরুরি

চাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনিসহ নিত্যপণ্যের পর এবার সিন্ডিকেট সক্রিয় কাগজের বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে কাগজের দাম। এ সুযোগ নিচ্ছেন দেশের মিলমালিক ও আমদানিকারকরা। কাগজের ডিলার ও পাইকারদের এতে সমস্যা না হলেও বেকায়দায় পড়েছেন প্রকাশক ও ভোক্তারা। কাগজের দাম বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে শিক্ষা উপকরণেরও। ফলে চাপে পড়েছেন অভিভাবকরা।

বৈশ্বিক সংকটের মুখে মানভেদে গত এক বছরে কাগজের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ। ডলার সঙ্কটের কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। আবার গ্যাসের চাপ না থাকায় মিলে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া চলমান বাজার পরিস্থিতি সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে প্রিন্টিং পেপারের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ না থাকায় নববর্ষের প্রথমদিন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া যাবে কি না সেটা নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় যে, বছরের প্রথম দিনে যদি বই উৎসব করা না যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়বে। যেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। অন্যদিকে বইমেলার মাত্র আড়াই মাস বাকি। বেড়ে গেছে প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট উপাদানের দাম। এ নিয়ে লেখক-প্রকাশকরা হতাশা প্রকাশ করছেন। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাবে বইয়ের দামও। সে ক্ষেত্রে পাঠক হারানোর ভয় পাচ্ছেন তারা। ফলে কয়েকজন প্রকাশক ও লেখক নতুন বই প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ, কাগজের বাজারে অস্থির অবস্থা।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা

কিছুদিন আগেও ৫৫ গ্রাম ডাবল ডিমাই সাইজের এক রিম কাগজের দাম ছিল ১৪০০-১৫০০ টাকা। বর্তমানে এ কাগজ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২৪০০ টাকা দরে। একই সাইজের ১৮০০ টাকার ৬৫ গ্রাম কাগজ বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকা দরে। ২০০০ টাকার ৭০ গ্রাম কাগজ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা দরে। ২২০০ টাকার ৮০ গ্রাম কাগজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ টাকা দরে। ১০০ গ্রামের রিয়েল আর্ট পেপার ১ রিম বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫০০০ টাকা দরে। ফলে প্রতিনিয়ত দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন লেখক-প্রকাশকরা।

ত্রিমুখী সংকটের কারণে বেসামাল হয়ে পড়েছে দেশের কাগজের বাজার। বিশেষ করে দেশীয় নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ার কারণে সংবাদপত্র শিল্পের প্রকাশনা অব্যাহত রাখায় দেখা দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। কাগজের আমদানি, দেশীয় উৎপাদন, সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং এ খাত নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশীয় শিল্প বিকাশে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত পাল্প দেশীয় পুরনো কাগজ রিসাইক্লিং করে পাওয়া যায়। তবে সাদা কাগজ উৎপাদনে পাল্প আমদানি করে থাকেন উদ্যোক্তারা। ডলার সংকটের কারণে কাগজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল বা পাল্প আমদানি করতে পারছেন না মিলমালিকরা। এমনি ব্যাংকগুলো ঋণপত্র বা এলসি খুলছে না। এ অবস্থায় দেশীয় কাগজ উৎপাদন এখন বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কমে গেছে। দ্রুত সরবরাহ না বাড়লে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় খাতাপত্র পাবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মিলে কাগজ উৎপাদনে আবার বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের প্রয়োজন রয়েছে সেটাও পর্যাপ্ত না পাওয়ায় সংকট নিরসন হচ্ছে না। যেসব মিলের প্রতিদিন ৫০০ টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে তারা এখন ৭০ থেকে ৮০ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। এ অবস্থায় সংকট বাড়ছেই। আবার শিল্পে ব্যবহার হয় এমন সব কাগজ আমদানিতে ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক গুনতে হচ্ছে। কাগজের এই সঙ্কটকে পুঁজি করে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বেড়েছে। কাগজের অবৈধ মজুতের আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে মিলারদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে খাতসংশ্লিষ্টরা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ওপর।

>> আরও পড়ুন: মালদ্বীপ শুধু দ্বীপ নয়, যেন মায়ার বাঁধন


বিজ্ঞাপন


সিন্ডিকেটের কারসাজিতে গত এক বছরে নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি। এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে টনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। হঠাৎ নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধিতে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে সংবাদপত্রসহ মুদ্রণ শিল্পে। ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারি কোনো শিল্প না থাকায় বেসরকারি খাতের মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে নিউজপ্রিন্টের।

ইতিমধ্যে চাল, তেল, চিনিসহ বাজারে নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট নিয়ে প্রচার মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাম্পার ফলনের পরও সিন্ডিকেটের কারণে চালের বাজার অস্থির। সাম্প্রতিক সময়ে সয়াবিন তেল নিয়ে বাজারে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাও সিন্ডিকেটের কারণে। সিন্ডিকেট কাজ করছে ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও সিন্ডিকেট চক্রের হাত থেকে বাজার মুক্ত করার তেমন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।

>> আরও পড়ুন: দৃষ্টিহীন ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা

এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নিউজপ্রিন্টের ক্ষেত্রেও। মিল মালিকরা বলছেন, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী নিউজপ্রিন্টের প্রধান কাঁচামাল দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পুরনো কাগজ নিউজপ্রিন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল। ব্যবহৃত কাগজ রি-সাইক্লিং করে কাগজের পাল্প তৈরি করা হয়। এছাড়াও কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় নরম কাঠ, পাটখড়ি ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিকৃত কাঁচামালের কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি হলেও কাগজের দাম বৃদ্ধির তুলনায় খুব কম। বর্তমানে নিউজপ্রিন্টের বাজার প্রতিযোগিতাহীন। বেসরকারি মিল মালিকরা সবাই মিলে দাম নির্ধারণ করেন ইচ্ছেমতো। ফলে কাগজ ব্যবহারকারীদের কাছে কোনো বিকল্প থাকে না। একটা সময় ছিল দেশের অধিকাংশ নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ হতো খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায় ২০০২ সালে। ক্রমাগত লোকসানের কারণ দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা হয়। এর পেছনে বেসরকারি মিল মালিকদের কারসাজির কথাও বলা হয়। সরকারি মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি মিল মালিকরা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। বিভিন্ন সময় আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল চালু করার কথা বলা হলেও গত দুই দশকেও তা সম্ভব হয়নি। এর ফলে কাগজ ব্যবসায় নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। দাম বাড়ানো হচ্ছে ইচ্ছেমতো। ভোগ্যপণ্যের মতো নিউজপ্রিন্টের বাজারেও অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। কাগজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে দ্রুত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল চালু করা উচিত। একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্টের বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।

বছরের এ সময়ে নতুন বই ছাপানোর জন্য সাড়ে ৮ লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়। কাগজ সঙ্কটের কারণে বছরের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এখন যে কাগজ আছে তা দিয়ে ৩ কোটি বই তৈরি করা সম্ভব কিন্তু প্রাথমিকেই বই লাগবে ১০ কোটি। আবার সামনে মহান ২১ ফেব্রুয়ারির উৎসব রয়েছে। সেই সময় বই প্রকাশের একটি তাড়া থাকে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সেটা হয়তো এবার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশীয় মিলারদের কাছে প্রকাশকরা জিম্মি। এ কারণে প্রকাশকদের সরাসরি শূন্য শতাংশ শুল্কে কাগজ আমদানির সুযোগ দেয়া হোক। নতুবা ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে সব বুঝে শুনেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর