‘এই মহিলা আপনারে গাড়ি চালাইতে বলছে কে? ঘরে কাজ নাই!’
এমন দুর্বাক্য একজন নারী বাইকারকে প্রতিদিন শুনতে হয়, আমাকেও শুনতে হয়েছিল। গণপরিবহনের দুরাবস্থা, ঢাকার যানজট, পত্রিকার পাতায় পাবলিক বাসে নারীদের হয়রানির খবর এবং সর্বোপরি কৈশোর থেকে বাইকের প্রতি আকর্ষণ থেকে ২০১৭ সালে আমি একটা স্কুটার কিনি। প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হতেই আমি সাইক্লিং-এ নানান নৈপুণ্য দেখাতে সিদ্ধহস্ত ছিলাম। যেদিন স্কুটার কিনতে গেলাম শো-রুমের ছেলেটার কাছে যন্ত্রটি কীভাবে স্টার্ট দিতে হয় তা দেখে নিলাম। সেই যে গাড়ির চাকা ঘুরলো তা অদ্যাবধি চলছে। গাড়ির চাকা যত ঘুরছে ড্যাশ বোর্ডে তত কিলোমিটারের হিসাব বাড়ছে। সেইসঙ্গে আমি প্রতিদিন নানাবিধ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। ফলে নানা উপলব্ধি মনে জড়ো হচ্ছে। কিছু বোধ একেবারে নিজের হলেও তা এখন অন্যদের জানানো বোধকরি সময়ের দাবি।
বিজ্ঞাপন
আমি যখন স্কুটার চালাই তখন ঢাকার রাস্তায় হাতেগোনা কয়েকজন নারীকে ড্রাইভিং সিটে দেখা যেতো। এখন শখে হোক বা প্রয়োজনে রাজধানীসহ দেশের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নারীরা নিজেকে মোটরসাইকেলের সিটে চালকের আসনে বসিয়েছে। করোনা মহামারির পর যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখন বাংলার মেয়েরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ৬৪টি জেলায় স্কুটারে চেপে দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
এসব আশাব্যঞ্জক খবর হলেও মন খারাপ করা খবর হলো অনেক নারীই স্কুটার চালাতে গিয়ে হরহামেশাই নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এতে তাদের ড্রাইভিংয়ের প্রতি আগ্রহ কমছে। ফলে গত চার-পাঁচ বছরে নারী বাইকারদের স্বতন্ত্র পরিচিতি নারী অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
আত্মবিশ্বাসের সাথে নারীরা দু-চাকার যানে ভর করে পরনির্ভরশীলতা কমাতে চেয়েছে। সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে একজন মা চেয়েছেন গৃহকর্তার চাপ কমাতে, ভাইকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে একজন বোন চেয়েছেন পিতার বাড়তি চাপ কমাতে, একজন কর্মজীবী নারী গণপরিবহনের নাকাল অবস্থা হতে পরিত্রাণ চেয়েছেন। চেয়েছেন ভোগান্তি ছাড়াই যথাসময়ে নিজের কর্মস্থলে পৌঁছাতে।
আরও পড়ুন: নারীবাদ আন্দোলন বিতর্কিত করছে কারা?
বিজ্ঞাপন
আমাদের সমাজে সবচেয়ে কঠিন হলো নিজের মতো হওয়া! বিশেষ করে নারীরা যখন নিজের পছন্দ মতো, নিজের সুবিধা মতো চলতে চায় তখন তাদের ওপর ফতোয়ার বর্শা নিক্ষেপ করা হয়। কোনো নারী যখন বলিষ্ঠ আর দৃঢচেতা মনোভাব দেখায় তখন তাকে নারীবাদী তকমা দেওয়া হয়। আজকাল এদেশে 'নারীবাদী' শব্দটা নারীকে অবমাননা করে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে অহরহ ব্যবহার হয়। সংবাদমাধ্যম ও বইপত্রে নারীদের প্রতি নানা অসমতা আর নিগৃহের খবর জানলেও আমি নিজেকে দিয়ে একপর্যায়ে এ বিষয়ের সত্যতা খুঁজে পাই।

শখ বা ইচ্ছেদের কোনো বয়স থাকে না। পরিচিত ব্যাংক কর্মকর্তা এক আপা যিনি দুই সস্তানের মা একদিন দুঃখ করে বললেন, ‘স্কুটারটা বেচে দেবো, রাস্তাঘাটে মানুষে বুড়ি বলে গালাগাল দেয়!’ মনটা সেদিন বিষাদে ভরে গিয়েছিল। বিভিন্ন ভাবনা মাথায় ভর করলেও একটা জিজ্ঞাসা থেকে নিস্তার পাচ্ছিলাম না। যাদের কটূক্তি উনার আত্মবিশ্বাস ভেঙে উনাকে পিছপা হতে বাধ্য করলো উনি কার কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন? আপা ওদের মানুষ বলেছিলেন। কিন্তু আমার ওদেরকে সুস্থ মানুষ মনে হয়নি। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের আশেপাশের, পরিচিতজন যাদেরকে আমরা এই পরিচয়ে চিনি না। যাদের ভেতর এত কপটতা, এত চিত্তদাহ তাদের কে সুস্থ বলি কী করে!
গত ছয় বছর ধরে মানুষের শ্রুতিকটু কথায় পলির আস্তরণ দিয়ে আমি নিজেও স্কুটারের ব্রেক শক্ত হাতে ধরে আছি। ট্রাফিক সিগন্যালে পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে নানা কীর্তি দেখা যায়। 'কেউ পায়ের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউবা চোখ দিয়ে আপাদমস্তক স্ক্যান করে, কেউ অপলক চোখে চেয়ে থেকে ট্রাফিক সবুজ সংকেত দিলেও গাড়ির স্টার্ট দিতে ভুলে যায়।' আবার শোনা যায় 'কলিকাল আইছে মাইয়া মানুষ গাড়ি চালায়। আজকাল মাইয়াগো পাখনা গজাইছে।'
একদিন বিজয় সরণির জ্যামে এক মুরব্বি সিএনজি চালক ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলেন, ‘বেগানা মহিলা গুলানের লাইগা এহন আর আগের মতো ক্ষ্যাপ ও পাইনা। হেরাও উবার চালায়।’
আরও পড়ুন: নারী: অন্তরের সৌন্দর্যে আলোকিত হোক
কথিত আছে, ঢাকার রাস্তায় যারা নিরাপদে ড্রাইভিং করতে পারবে তারা পৃথিবীর সব রাস্তার জন্যই মানানসই। রাস্তাজুড়ে ভয়াবহ বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্যই একথা বলা হয়। ড্রাইভিং অত্যন্ত নিখুঁত মনোযোগের একটি কাজ। হুটহাট গাড়ির খুব কাছে এসে কেউ কেউ এমন বিকটভাবে হর্ন দেয় যে, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ও নিজের ভারসাম্য রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে। মেয়েদের অন্তর্দৃষ্টি বেশ প্রখর। কে কোনটা ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় করছে, কী প্রবৃত্তি নিয়ে তাকাচ্ছে তা মুহূর্তেই টের পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মন বিদ্রোহ করে ওঠে। সমস্ত কথার সমুচিত জবাব দিতে ইচ্ছে হয়। দাতে নখ চেপে নিজেকে ভদ্র মানুষের কাতারে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করি!
নিজের জরুরি প্রয়োজনে কিংবা অজান্তেই যদি কোনো পুরুষকে রাস্তায় ওভারটেক করেছি তখন সে পুরুষ রেস মুডে ওভারটেক করতে মরিয়া হয়ে যায়। আমার প্রশ্ন আসে, গিয়ারলেস একটা স্কুটার নিয়ে একজন নারী দু'কদম সামনে এগোলে তা যদি সহনীয় না হয় তবে বিশ্বজুড়ে নারীর এত সফলতা, এত জয়জয়কার এই সকল পুরুষ কীভাবে সহ্য করে? এক শুক্রবার সকালবেলায় কলাবাগানে এক প্রাইভেটকার ইচ্ছেকৃত আমার স্কুটারে চাপ দিয়ে ছুটে পালায়। আমি আইল্যান্ডের উপর পড়ে যাই। নিজেকে দ্রুত সামলে রক্তাক্ত পা নিয়ে রাপা প্লাজার সামনে গিয়ে প্রাইভেট কার টাকে ধরতে সক্ষম হই। চালকের আসনে বসা ব্রান্ডের পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়সী লোকটিকে সম্ভ্রান্ত মনে হলো। সম্ভবত তার নিজের গাড়ি। ভদ্রলোক গোছের লোকটির কাছে আমার শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, কী কারণে তিনি আমাকে ফাঁকা রাস্তায় পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও চাপ দিয়ে পালালেন?
লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে উত্তর দিলেন, ‘এই মহিলা আপনারে গাড়ি চালাইতে বলছে কে? ঘরে কাজ নাই!’
কতবার যে সিএনজি চালক ধেয়ে এসে চাপ দেবার চেষ্টা করেছে, অফিস ফেরত ব্যাংকার আইডি ঝুলানো বাইক আরোহী চলন্ত অবস্থায় মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো চোখে ফেলে আমার হাতের নিয়ন্ত্রণ এলোমেলো করে দিয়েছে। এমনকি রিকশাওয়ালারা ও খিস্তি দেখাতে বাদ যায়নি। সুযোগ পেলেই চোখ-মুখের নানা ভঙ্গিতে অভিঘাত হেনেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু কলাবাগানের প্রাইভেট কারওয়ালার কথাটা আমাকে এতখানি স্তম্ভিত ও পীড়িত করেছিল যা আজও কানে বাজে।
মালয় মেয়েরা কলেজে ভর্তি হলে তাদের সাইকেল বা স্কুটার কিনে দেওয়া হয়। মাথায় হিজাব পরিহিত ইন্দোনেশিয়ান মেয়েদের চিত্র ও অনেকটা একইরকম। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখেছি বয়স্ক মহিলারা কোমরে শাড়ির আঁচল বেঁধে স্কুটার চালাচ্ছে। যুবতী মেয়েরা ওড়না ছাড়াই কামিজ পরে ১৫০ সিসির মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। কটাক্ষ-বান তো দূরে থাক তাদের দিকে কোন পথচারী বা চালক ভ্রুকুটি করেও তাকায় না। আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে অনুকরণ করার প্রবণতা রয়েছে। এসব বিষয়ে কেন আমাদের অনুকরণ নেই? অন্যান্য দেশে যখন নারী-পুরুষের সহযাত্রা তখন আমাদের যাতায়াতের জন্য রাস্তায় নারীদের আলাদা পরিবহন লাগে। এর কারণ এখনো ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়।
আরও পড়ুন: বিবাহ-বিচ্ছেদের দায় কি একা নারীর?
ছোটবেলায় আব্বা বুকে আগলে সাতার শিখিয়েছেন, সাইকেল চালানো শিখিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমি নিজ চেষ্টায় প্রাইভেটকার চালানো শিখেছি। একজন বাবা চাইলে তার মেয়েকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথগুলো বাতলে দিতে পারেন। একজন ভাই ইতিবাচকতার বীজ বপন করে জীবনপথে বোনকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। একজন স্বামী পারেন তার স্ত্রীর শখ-ইচ্ছে, আস্থা ও সফলতার অংশীদার হয়ে সুখী জীবনযাপন করতে।

বেশিরভাগ পুরুষ চালকের আসনে আমাকে ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো করে দেখলেও দু'একটা ঘটনা আমায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। একবার উত্তরা হতে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত একজন পুরুষ বাইকারের সাথে আমি পুরোটা পথ প্রায় পাশাপাশি চালিয়ে এসেছি। যখন পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো তিনি একটু থেমে স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘আপা আপনি কিন্তু দারুণ চালান।’ জ্যামের মধ্যে বসে সুপ্রিম কোর্টের একজন রেজিস্ট্রার গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বললেন, ‘তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। আশি সালে আমি এলএমএল ভেসপা চালাতাম।’ একবার এক রিকশাচালক চাচা জানতে চাইলো, ‘মা, এ গাড়ি কেনতে কত টাকা লাগে? আমার মাইয়াডা কলেজে পড়ে। ওরে একটা কিন্না দিতে চাই।’
দেড় হাজার বছর আগে নারীরা ঘোড়সওয়ার ছিলেন, উট হাঁকাতেন, যুদ্ধে যেতেন আর এখন আমরা বাইক বা স্কুটার চালানো কে প্রথাবিরোধী মনে করে ধর্ম আর সামাজিক নীতির বাদানুবাদে জড়িয়ে যাই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যখন উঠে আসে নারীর পাহাড় জয়ের খবর, নারীর মোটরসাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণের খবর তখন আমাদের দেশে কোন মেয়ে মোটরসাইকেলে দুপাশে পা দিয়ে বসলে তা নিয়ে কেলেংকারি কাণ্ড হতে আটকায় না। বেপরোয়া গতিতে বা মদ্যপ অবস্থায় একজন পুরুষ গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে তা নিছক দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু একজন নারী ট্রাফিক নিয়ম মেনে অন্যর ভুল চালানোর খেসারত দিতে গিয়েও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তখন একটা শ্রেণি সমস্বরে চিৎকার করে উঠে যেন সব দোষ মেয়েদের! যেন কোথাও পুরুষের দায় নেই। পুরুষের মুখের লাগাম, চোখের পর্দা কোনটার যেন দরকার নেই।
আরও পড়ুন: নারীর আত্মশক্তি জেগে উঠুক
সারাবিশ্বে গড়ে পুরুষদের তিন ভাগের এক ভাগ অধিকার ভোগ করে নারীরা। আমাদের দেশের চিত্র কিছু ভিন্ন নয়। পুরুষের পাশে নারীরা বহুকাল ধরে এদেশে সংকুচিত ও নির্যাতিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন তার অন্যতম নারীর ক্ষমতায়ন। দেশের বৃহৎ নারী গোষ্ঠীকে শুধু ছাপার অক্ষরে আশাবাদী করে, নারী দিবসে সম্মান জানিয়ে, মৌখিক সমতার কথা বলে সমাজের মূলধারায় আনা যাবেনা। এজন্য পুরুষের অন্তরের দ্বিভাব, মনে আঁকড়ে থাকা কৃত্রিমতা দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহাবস্থান একান্ত জরুরি। নারী-পুরুষ কেউ কারো শত্রু নয় বরং সর্বক্ষেত্রে একে অন্যর পরিপূরক। নারীর পথে কাঁটা না বিছিয়ে, নারীকে একা করে না দিয়ে, বরং নারীর বহুমুখী কর্মোদ্যোগে তার সহচর হলেই পরিবার-সমাজ ও দেশ অগ্রগামী হবে। এই সত্য আমরা যত দ্রুত হৃদয়ে ধারণ করতে পারবো ততই মঙ্গল।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও লেখক

