মিজানুর রহমান আজহারী অল্প বয়সী হলেও বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদীন এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি দীন প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতিসহ পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও তার মাহফিলে আলোচনা করেন। কোরআন-হাদিসের আলোকে তার আলোচনা জনগণের হৃদয় জয় করে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রোতার মনের মণিকোঠায় তার স্থান। ইতোপূর্বে ফ্যাসিস্ট রেজিমে তিনি ইসলাম প্রচারে সর্বত্রই বাধাগ্রস্ত হন। গ্রেফতার-হত্যা হুমকিসহ তাকে নানাভাবে হেনস্থা করায় এক পর্যায়ে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগ এবং এদেশীয় কিছু ভণ্ড আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখের কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আওয়ামী লীগের ও তাদের দোসর এই মৌলভীদের উল্টাপাল্টা ফতোয়া ও বিরূপ মন্তব্য-বক্তব্য তাকে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। যে কারণে আওয়ামী লীগ ইসলামবিদ্বেষ থেকেই তার প্রতি বিদ্বেষগ্রস্ত। সকল হকপন্থী আলেমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এহেন অনৈতিক আগ্রাসী মনোভাব ফ্যাসিস্ট লীগকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
মিজানুর রহমান আজহারী মালয়েশিয়াতে দেশান্তরি হওয়ার আগে দেশের ভেতরে যেখানেই মাহফিল করেছেন লাখো লাখো জনতা কোরআনের আবেদনে সাড়া দিয়ে তার মাহফিলে উপস্থিত হয়েছে। এসব মাহফিলে সুদূরপ্রসারীভাবে সুমিষ্ট ভাষায় পরোক্ষভাবে ফ্যাসিস্ট লীগকে সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগ মূলত নিজেদের ক্ষতির কারণ হিসেবে নেয়। যে কারণে আওয়ামী লীগ তার বিষয়ে বিভিন্নভাবে অপসমালোচনা ও অপপ্রচার চালায়। দীন ও ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সম্পর্কে বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য কথাবার্তা আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার অপপ্রচার চালানোর কারণে জনগণ নানামুখী অত্যাচারের সাথে ধর্মীয় বিষয়কে সম্পৃক্ত করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে।
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম খুনি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যায়। রাজা লক্ষণ সেনের দেশে হাসিনা পালিয়ে যায়। বিএনপির কিছু নেতা বিভিন্ন মাহফিলে আলেমদের বাধা দিচ্ছে। এই বাধা দেওয়া ঠিক আওয়ামী লীগের সাথে মিলে যায়। ফলে জনগণ তাদের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু কেন এই বাধা দেওয়া। কেন বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ফজলুর রহমান সাহেবরা মিজানুর রহমান আজহারী বা জামায়াত সম্পর্কে বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করছেন? তার একটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
বিএনপি-জামায়াত জোট: সুদীর্ঘ ১৫ বছর বিএনপি-জামায়াত জোট একমত হয়ে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন মুক্তির একদফায় রাজপথে আন্দোলনে শামিল ছিল। এর-ও পূর্বে জামায়াত অবশ্য ’৯১ থেকে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তারও পূর্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে। অর্থাৎ জামায়াত তেমন একটি রাজনৈতিক দল তারা দেশের প্রয়োজনে, জনগণের প্রয়োজনে দুঃশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে, সংগ্রাম করতে, রক্ত দিতে, শহীদ হতে পশ্চাদপদ নয়। অত্যন্ত সুদূরচিন্তক ও শক্তির ওপর স্থাপিত জামায়াতে ইসলামী। সেই শক্তির নাম বাংলাদেশ ছাত্রশিবির। জুলাই গণঅভ্যুত্থান শিবিরের ছত্রছায়ায় এবং শিবিরের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, সমর্থন ও সহযোগিতায় সংঘটিত হয়। সুতরাং জামায়াত শিবির খেলনা নয়। তবে জামায়াত-শিবিরকেও বুঝতে হবে, বাংলাদেশে তাদের ভোটের আনুপাতিক হার খুবই কম। সব মিলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। তাও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে। পক্ষান্তরে বিএনপির ব্যাপক ভোটব্যাংক ও জনসমর্থন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সুসংগঠিতভাবে সমর্থন না করলে গণঅভ্যুত্থান বৃথা যেতে পারত।
এখন মিজানুর রহমান আজহারী সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন না করলেও কোরআন ও হাদিসের হক ব্যাখ্যার কারণে তা অনেক ক্ষেত্রেই জামায়াতের আদর্শের সাথে মিলে যায়। এতে অনেকে তাকে জামায়াতের আলেম মনে করতে পারেন। যে কারণে আজাহারী সাহেবের উচিত নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা। প্রকৃত দাঈদের কাজ হচ্ছে সকলেরই সমানভাবে সমালোচনা করে সুমিষ্টভাবে তাদেরকে সমৃদ্ধ হওয়ার পথে অগ্রসর করানো। সেটা তিনি ভালোভাবেই করেন। তবে বয়সজনিত কারণে হয়ত কিছু কিছু কথা সঠিক হলেও সুন্দর শোনায় না। যে কারণে মাঝেমধ্যে বিতর্ক বিভেদ সৃষ্টি হয়। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আজহারী ও দুদু: যশোরের মাহফিলে ২০ লক্ষাধিক শ্রোতার সামনে আজহারী সাহেব বলেন, ‘এক দল খাইছে আরেক দল খাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে’। তিনি সুনিশ্চিতভাবে কোনো দলকে সংজ্ঞায়িত করেননি বা নাম উল্লেখ করেননি। তবে দেশের জনগণ বুঝতে পেরেছে, বিএনপিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেই ইঙ্গিতের জবাব বিএনপির বিজ্ঞ রাজনীতিবিদগণ ইঙ্গিতের মাধ্যমে দিতে পারতেন। তারা বলতে পারতেন যাদের সাথে বিএনপির মিল খোঁজা হচ্ছে তাদের সাথে বিএনপির মিল নেই। তারা কখনোই জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতাকে ফাঁসি দেননি। তারা গোলাম আযম সাহেবকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। যারা মিজানুর রহমান আজহারীকে দেশান্তরিত করেছে, মুফতি আমির হামজাকে আয়না ঘরে নিয়েছে, হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করেছে, মাদরাসার এতিম ছাত্রকে ৫ মে শাপলা চত্বরে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, যারা লেন্দুপ দর্জির মতো ভারতের কাছে নিজেদের বিক্রি করেছে, যারা মূলত ভারতেরই এজেন্ডা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করেছে, যারা এদেশের প্রাণপুরুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের মেধাবী ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে, যারা বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে, যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবকে ধ্বংস করেছে, যে প্রধানমন্ত্রী তার ছেলেকে আমেরিকায় রেখে সেখানে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে, যারা লক্ষ লক্ষ বিএনপির নেতাকর্মীকে রাতে বাড়িতে ঘুমাতে দেয়নি, যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়ে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের ভোগ করেছে, তারা এবং বিএনপি এক নয়। তাদের সাথে আজহারী সাহেব এগুলো তুলনা করে নিজেই একসময় বিতর্কিত হবেন। এমন বললে খারাপ হতো না।
বিজ্ঞাপন
অথবা বলা যেত বাস টার্মিনাল লঞ্চঘাটে যদি বিএনপি-জামায়াতের শ্রমিক দল দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তাহলে কিছুদিন পরে তো তারা ষড়যন্ত্র করে সারা বাংলাদেশে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করে দেবে। কারণ সেখানকার নেতারা তো সব আওয়ামী লীগের। অতএব এটি দখল নয় বরং ভবিষ্যতে যেন ষড়যন্ত্র না করতে পারে তার জন্য মৃদু দায়িত্ব গ্রহণ। দায়িত্ব গ্রহণ ও দখল এক বিষয় নয়। কিন্তু তা না বলে দুদু সাহেব বললেন, ‘আজহার না মাজহার কে যেন আছে? তিনি বিএনপিকে নিয়ে কুমন্তব্য করেছেন।’ মিজানুর রহমান আজহারীকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ চেনে। মাজহার বলে, এই হুজুরকে ছোট করলেন। ক্ষুদ্র মনে করলেন। এর জন্য এমন হতে পারে, সামনে নির্বাচনে দুদু সাহেব তার আসনে সফল হলেন না। কারণ শামসুজ্জামান দুদু সাহেব এক মাস প্রচেষ্টা করে এক মাস ধরে জনসভা করলেও সকল জনসভা মিলে যত জনগণ আসবে মিজানুর রহমান আজহারী কোনো মাহফিলে যাওয়ার পথে পথসভা করলে তার থেকে বেশি জনগণ দৌড়ে আসে। সুতরাং বিপুল জনপ্রিয় এই আলেমকে তাচ্ছিল্য করলে নিজেদেরই ক্ষতি হয়।
একটি বিষয়, আজহারী সাহেবেরও ভাবা উচিত। রাখাল শব্দের ইংরেজি অর্থ কাউবয়। কাউবয় শব্দটি কঠোর ও নিম্নমানের। নবী করিম সা. নিশ্চয়ই মেষ চরাতেন। এই রাখালি করার মধ্য দিয়ে ধৈর্য সহনশীলতার অপার শিক্ষা প্রদান করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তাই ইংরেজিতে কাউবয় আর মেষ চরানো সমর্থক হলেও প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। শ্রুতিমধুর হয় না। নবীর মতো এত বড় মহামানবের জন্য শব্দটি যেন খুবই নগণ্য ও অপ্রযোজ্য। তাছাড়া আজহারী সাহেবকে প্রায়শই দেখা যায়, সহজ একটি বাংলা সেন্টেন্সকে পট করে উনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে মাহফিলে বলেন। এটি ভালো শোনায় না। উনি ইংরেজিতে অনেক ভালো। সেটি উনি বিদেশিদের সামনে বক্তব্য দেওয়া বা আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে বক্তব্য দেওয়ার সময় ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের দেশের মানুষ বাংলা বোঝে। আরবি না বুঝলেও আরবি ভাষার আল্লাহ প্রদত্ত যে সুমিষ্ট বৈশিষ্ট্য সেটাতে মানুষ স্বভাবগতভাবেই আকৃষ্ট করে। শহীদ আল্লামা সাঈদী হুজুরও ইংরেজিতে স্কলার ছিলেন। তবে তিনি মাহফিলে এমনভাবে হালকা ইংরেজি বলতেন না। হয়তো বিদেশে গিয়েছেন ইমিগ্রেশন ফেস করেছেন বা কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলেছেন; সেরকম দুই একটি কথা হয়তো ৪০ বছরের দীন কায়েমের সংগ্রামে তিনি বলেছেন দুই একবার।
আমি মনে করি, এখন যারা হকপন্থী আলেম তারা সুযোগ পেলেই ইউটিউব থেকে আল্লামা সাঈদীর ওয়াজ শুনতে পারেন। কেউ কেউ তাঁর কণ্ঠ নকল করেন, কেউ কেউ তাঁর মতো করে কথা বলেন, এটির প্রয়োজন নেই। নিজের মতো করে নিজের বৈশিষ্ট্য বলুক। কিন্তু কথা বলার যে ধরন, স্টাইল, ব্যক্তিত্ব তা সেখান থেকে শেখা যেতে পারে। আল্লামা সাঈদী ছিলেন তো ‘অনেক কথাই যাও যে বলি কোন কথা না বলি’ এমন বৈশিষ্ট্যের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’কিন্তু আল্লামা সাঈদী ঠিক রবি ঠাকুরের উল্টো ছিলেন। শহীদ আল্লামা সাঈদী সহজ কথা সহজ করেই বলতেন। কারণ কোরআনের শিক্ষাই এটা। সহজ কথা সহজ করে বলা। কোনো বক্রতা নেই। কারণ এটা সিরাতাল মুস্তাকিমের পথ।
বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্বে কার লাভ: জনাব শামসুজ্জামান দুদুর রাজনীতির দল স্পষ্ট। অন্যপক্ষে মাওলানা আজহারীর রাজনীতির কোনো দল নেই। সুতরাং এই বিতর্ককে সরাসরি রাজনীতিতে না টানলেই মঙ্গল। কারণ এটিকে বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সত্যি সত্যিই বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করলে আওয়ামী লীগের-ই লাভ। এই ফ্যাসিস্ট তস্করদের লাভ করে দেওয়া বিএনপি-জামায়াতের উচিত হবে না। যাই হোক, বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না। বাংলাদেশের জনগণ দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক ইসলামিক শক্তি ক্ষমতায় চায়। এই তিনটিই বৈশিষ্ট্য যেহেতু একক কোনো দলের মধ্যে পরিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ হবে পাওয়া যায় না, তাই বিএনপি ও জামায়াতবদ্ধ হলেই তিনটি বৈশিষ্ট্য একসাথে পাওয়া যায়। সংঘাত বিভেদ নয়, একতাই শক্তি একতাই বল। বিএনপি ও জামাত যত দ্রুত এটা বুঝবে ততই জাতির কল্যাণ, মানুষের কল্যাণ। রাজনীতির কল্যাণ। দেশের কল্যাণ। শুধু ভারত ও আওয়ামী লীগের জন্য অকল্যাণ।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

