সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আঁধার থেকে উঠে আসে হিরন্ময় হাতিয়ার

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

আঁধার থেকে উঠে আসে হিরন্ময় হাতিয়ার

মহান বিজয় দিবস বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় দিন। হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন বিজয় দিবস। এদিন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। বাঙালি জাতির গৌরবের দিন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় বাঙালি জাতি। দেশের প্রতিটি প্রান্তে শুরু হয় বিজয়ের মিছিল। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে সারা বিশ্বের বাঙালিরা। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজের পতাকা বাঙালি দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পরে অর্জন।

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান শেষ করে স্বাধীকার আন্দোরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি। অন্যদিকে পাকিস্তানিরাও হিসেব-নিকেশ কষতে থাকে বাঙালির মুখে কলুপ এঁটে দেয়ার। কীভাবে বাঙালি জাতিকে যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শেকল পরিয়ে রাখা যায় সে হিসাব কষে তারা ব্যবস্থা নেয়ার অপেক্ষায় থাকে। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দ জানিয়ে যায় সময় আসে হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দেয়ার পালা। বাঙালিও সাজে রণসজ্জা। বিশেষত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঘটে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।


বিজ্ঞাপন


গভীর কালো আঁধার থেকে উঠে আসে যেন শিকল ছেড়ার হিরš§য় হাতিয়ার। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক বিশাল জনসমুদ্র থেকে যুগের কবি, মহাকাব্যের প্রণেতা বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, তবুও এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআললাহ।’ এই একটি মাত্র উচ্চারণে যেন বাঙালি সত্যিকার দিক-নির্দেশনা পেয়ে যায়। চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি। বাঙালি বুঝে যায় শেষ কামড় দেয়ার সময় আসন্ন। পাকিস্তানিরাও আর বসে নেই। পুরো জাতিকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে মারাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে ঘুমন্ত জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ।

আরও পড়ুন

গণমাধ্যম ও রাজনীতি
ফিলিস্তিনিদের লাশের মিছিল বাড়ছেই

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আÍত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের শাসনে প্রবৃত্ত হয়। বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধ— সব হবে পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেয়া ভাষা কেন্দ্রিক। পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার ভাষাকে উর্দু ভাষায় রূপান্তর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারলো না। বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যিনি নেতৃত্ব দিলেন তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমান।


বিজ্ঞাপন


মুজিবের অস্তিত্ব আর ভালোবাসা না থাকলে বাঙালি জাতি আজ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারত না। বাঙালি জাতি হতে পারত না। পারত না ইতিহাসের গতিধারা বদলিয়ে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে। মুজিব বাঙালিকে প্রকৃত বাঙালি হতে শিক্ষা দিয়েছেন। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ। আমরা আশা করছি, তার এই আদর্শ প্রতিটি বাঙালি গ্রহণ করেই বাঙালি হিসেবে ‘ভাইয়ের-মায়ের’ স্নেহকে সম্বল করে আমরা সাম্প্রদায়িকতাহীন জীবন-যাপন করব।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ৯ মাস ধরে সব রীতি-নীতি, আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বাঙালিদের হত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন করলেও প্র্রাণ বাঁচাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা তখন চারদিকে আশ্রয়ের খোঁজ করা শুরু করে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে কোথাও দাঁড়ানোর স্থান পায় না ঘাতকরা। জাতিগত জাগরণ চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে পাকিস্তানি শাসকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। কারারুদ্ধ করেছিল জাতির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানকে। অতঃপর তারই আহ্বানে সূচিত হয়েছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে আÍপ্রকাশ করে আরেকটি দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের তাহার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। বাঙালি যেন খুঁজে পায় তার আপন সত্ত্বাকে।

১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পরাজয় মেনে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আÍসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন মিত্রবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে ভোর থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নে পালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। সারা দেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতসহ সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়।

আরও পড়ুন

ঋণ খেলাপি ও টাকা পাচারকারীরা স্বস্তিতে, কোমরে দড়ি কৃষকের
বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক সুবিধাই সর্বজনীন পেনশন

৩০ লাখ মানুষের প্রাণ বলিদান হলো মাত্র ৯ মাসেই। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ আর সম্ভ্রম হারালো ২ লাখ মা-বোন। হাজারো ঘরবাড়ি, স্থাপনা ভস্মীভূত হয়ে দেড় কোটি লোক হলো উদ্বাস্তু। সেদিনের সেই ত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ গড়তে যারা অবদান রেখেছিল সেই সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবরা, ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। প্রভাত সূর্যের রক্তাভাব ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, জয় বাংলা বাংলার জয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। মহামুক্তির আনন্দ ঘোর এই দিনে এক নতুন উল্লাস জাতিকে প্রাণ সঞ্চার করে সজীবতা এনে দেয়। যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত বাঙালি চোখে আনন্দ অশ্রু আর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন অবশেষে মিলিত হয় জীবনের মোহনায়।

আজ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মনে পড়ে প্রয়াত কবি আসাদ চৌধুরীর সেই দুর্লভ দু’লাইন- ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলেছে কি তা বাংলাদেশ’। আজও সক্রিয় রয়েছে তারা, যারা কখনো বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ক্ষীণ আশা ছিল, পাকিস্তান ফিরবে। তাদের সেই আশা ফিকে হলেও তাদের তৎপরতা যে বন্ধ হয়েছে তা নয়। এখনও চলছে। স্বাধীনতাবিরোধী ঘাপটি মেরে থাকা পুরনো শকুনরা আবার পত্রপল্লবে বিকশিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের শক্তি দিয়ে এই অপচেষ্টা রুখতে হবে। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই অগ্রযাত্রা অভ্যাহত থাকলে শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। এই বিজয় দিবসে আমরা দুর্নীতি, ক্ষুধা, মাদক, দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশ চাই, যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সমঅধিকারভিত্তিক একটা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা থাকবে।

লেখক: আহসান হাবিব, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর