মহামারির ধকল সামলে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর পথে, সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে সংকটে ফেলে দেয় কৃষকদের। সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় বেড়ে গেছে খাদ্য ও জ্বালানির দাম, সেই সঙ্গে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না, যার মূল্য স্থিতিশীল বা কমেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। এর মধ্যে আমদানি করা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মসলা পণ্য, মাছ-মাংস, ডিম, শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ, চিনি এমনকি লবণের দামও বেড়েছে। পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের পণ্যের দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি এমন— সপ্তাহ ও মাসের ব্যবধানে এই তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে পণ্য কিনতে ভোক্তার যেন নাভিশ্বাস বাড়ছে।
আমাদের দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় যারা সেই কৃষকের ঋণ দেওয়া-নেওয়া নিয়ে সংকট অনেক পুরাতন। তাদের স্বল্প ঋণ বাকি পড়লেই শুরু হয় হইচই। তাদের কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে থানায় আনা হয়। মামলা হয় শত শত। আর দেশের বড় বড় ঋণ খেলাপি, টাকা পাচারকারীরা থাকে স্বস্তিতে— এ বাস্তবতা আমাদের দেশের। একটি কৃষিনির্ভর দেশের চিত্র এমন হওয়া মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। গণমাধ্যমে প্রকাশ, স্বল্প ঋণ নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন গরিব কৃষকরা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করে যারা ফসল উৎপাদন করেন, তাদের কাছ থেকে সামান্য কয়টি টাকা আদায়ের জন্য হচ্ছে একের পর এক মামলা। তারা কৃষিঋণ নিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত কৃষকের ঋণ আদায়ে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে ৭৪ হাজারের বেশি। অথচ শত কোটি, হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। উলটো দাপটের সঙ্গে তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে— এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ম রক্ষার মামলা করে ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাঘববোয়াল ঋণ খেলাপিদের রক্ষার্থে প্রায় সময় দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের বিশেষ সুবিধা। একের পর এক ব্যাংক উজাড় হচ্ছে, পিকে হালদারদের মতো কতজন দেশের টাকা মেরে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়, তাদের গ্রেফতার বা তাদের টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ তেমন কোনো পরিলক্ষিত না হলেও দেশের কৃষক যারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের মুখে খাবার জোগাতে কৃষি কাজ করে, মাঠে সোনার ফসল ফলায়, তার কৃষি ঋণ দিতে ব্যাংকের যত সমস্যা। আর ঋণ দিলেও ঋণ আদায়ের জন্য তার কোমরে দড়ি বাঁধা হয়। এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ব্যবস্থা বদল হওয়া দরকার।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফশিল করেছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এরপরও গত বছরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। পুনঃতফশিল করা ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশের কাছাকাছি হতো। এদিকে গত বছরের শেষে পুনঃতফশিল করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফলে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফশিল করা ঋণ এখন বেশি। এছাড়া ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
এদিকে গত অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে পুরো ব্যাংক খাত। এ সময় শুধু ঋণ বিতরণ নয়, আদায়ও বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করেছেন কৃষক, যা আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ আদায় বেড়েছে ৫ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কৃষি ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
স্বল্প ঋণের ক্ষেত্রে টাকা বকেয়া পড়লেই মামলা হচ্ছে নির্ধারিত সময়েই। জেলেও যেতে হয়েছে অনেককে। রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা এসব গরিব কৃষকের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৯৯ কোটি টাকা আদায়ে ১ লাখের বেশি মামলা হয়েছে কৃষকদের বিরুদ্ধে। বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, সামান্য টাকার জন্য গরিব কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হচ্ছে না। তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তারা তো টাকা পরিশোধ করে। গরিব কৃষক কখনো ব্যাংকের টাকা মেরে খায় না। খুব বেশি বিপদে না পড়লে তারা ব্যাংকের টাকা ঘুরানোর কথা না। সরকার ও ব্যাংকগুলোর উচিত কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে সরে আসা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বড় ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ২ লাখ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করা হয় মাত্র ২ লাখ ১৪ হাজার। অথচ কৃষকের মাত্র ৩৯৯ কোটি টাকা আদায়ে মামলা করা হয় এক লাখের বেশি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরিদ্র কৃষকদের এসব টাকা আদায় করতে যতটা তৎপর ব্যাংকগুলো, ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় বড় বড় জালিয়াত চক্র থেকে টাকা আদায়ে। কারণ, লুটেরাদের থেকে ঋণ আদায়ের উদাহরণ খুবই নগণ্য। দেশে একটা মহালুটপাটের অর্থনীতি চলমান রয়েছে। বড় ঋণ খেলাপি এবং পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা এতটাই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে, তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায় তারা সরকারেরই অংশ। অথচ ছোট ছোট দরিদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মোটেও অবাক হচ্ছি না। কারণ, যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এর থেকে ভালো কিছু আশা করার সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, দেশের খাদ্য সংকট নিরসনে কৃষকের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের ঋণ তাদের সঙ্গে কথা বলে আদায় করা হোক। কৃষকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।
বিজ্ঞাপন
দেশের ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা’ তাদের অর্থশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর মামলাগুলোকে ঝুলিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন এবং এই খেলাপি ঋণের বৃহদংশই তারা দেশের বাইরে পাচার করে বিদেশে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি কিনে বহাল তবিয়তে সপরিবার দেশে-বিদেশে দিনাতিপাত করছেন। আমাদের বিচারব্যবস্থার নানা সমস্যা ও দীর্ঘসূত্রতা বিবেচনায় নিয়ে এখন প্রয়োজন সব ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ খেলাপির বিচারকে ত্বরান্বিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন।
নামে বেনামে ভুয়া কাগজে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে বিদেশে পাচার করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ধরতে পারছে না। অথচ গরিব কৃষকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করার পরও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। জারি করা হচ্ছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে কৃষকদের সঙ্গে বসে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সংকট নিরসন সহজ হবে। দ্রুত এ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি আমাদের।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

