অনেকের মুখেই শুনি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। আমি পুরোপুরিভাবে এই মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।
কেন করছি তার বিস্তারিত বলার চেষ্টা করব...
বিজ্ঞাপন
ছাত্ররাজনীতি মানেই কোনো একটা দলের সদস্য হতেই হবে তা কিন্তু নয়। ছাত্ররাজনীতি তো সেটাও যেখানে কি না ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলে। হলের সিট ভাড়া কমানোর জন্য কাজ করে, কলেজ-ভার্সিটির বেতন কমানোর জন্য কাজ করে, সেটাই ছাত্ররাজনীতি। এই কাজ করতে গিয়ে যারা সামনে দাঁড়ায় তারাই ছাত্রনেতা। এজন্য ‘প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দিতে হবে’ বিষয়টা তা নয়। সমঝোতা বা আলোচনা কিংবা ইতিবাচক কর্মসূচির মাধ্যমেও হতে পারে।
অনেকের কাছে ছাত্ররাজনীতি মানেই একটা দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, সেই দলের সব কার্যক্রম পালন করা, দলের নেতার কথায় ওঠা আর বসা! আসলে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিকেই ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির নামে একটা চাটুকার প্রজন্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
ছাত্ররাজনীতি কেন বন্ধ করতে চায় সবাই?
ছাত্ররা অনেক খারাপ কাজ করে, কী কী খারাপ কাজ? চাঁদাবাজি করে, টেন্ডারবাজি করে, মারামারি করে। এবার খোঁজ নিয়ে দেখুন যুবক নামে, স্বেচ্ছাসেবক নামে কিংবা অন্য নামে আরও অনেক দল আছে, যারা এসব কাজ ছাত্রদের চেয়ে বেশি ছাড়া কম করে না। তবুও কেন ছাত্ররাজনীতি নিয়েই সবার কথা? বড়দের রাজনীতি কেন বন্ধ করতে চায় না? কারণ ছাত্র জনতার ঐক্যমত হলে কেউ যে জায়গা পাবে না, ছাত্রজনতা সঠিক পথে এগিয়ে গেলে অন্য সবাই যে শান্তি কুনীতি চালাতে পারবে না। সকল পথ যে বন্ধ হয়ে যাবে!
বিজ্ঞাপন
যারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে স্বার্থ উদ্ধার করতে চায় তারা খুব ভালো করে জানে যে, ছাত্ররা যদি সঠিক পথে থাকে তাহলে সবকিছুই সঠিক তারা বানিয়ে ফেলবে। তাই ছাত্রদের মাঝে ক্ষমতার লোভ ঢুকিয়ে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে নখে নখে ঝড় তুলছে তারা। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি তো টেন্ডারের ভাগ চাওয়া নয়, ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে হল ভাড়া কমানোর দাবি করা, ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নামা। আর এটার জন্য যে কোনো দল করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
কিন্তু আমাদের দেশে এখন আসলে তেমন রাজনীতি অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশই গড়ে উঠছে নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে। নেতা যা বলবেন সবই ঠিক। এক কথায় বলতে গেলে একটা ‘সহমত ভাই’ টাইপের প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। কখনোই নিজ দলের বা দলের নেতার ভুল তাদের কাছ থেকে শোনা যায় না। আমাদের দেশে গুরু-শিষ্য/নেতা-কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা ‘জি স্যার’ ‘জি স্যার’ ধরনের। এখানে কোনো সমালোচনা বা ভুল দেখার সুযোগ নাই। আমাদের প্রজন্মকে যে পথে চালানো হচ্ছে সেই পথেই চলছি আমরা।
আরেকটা বড় দিক হচ্ছে, বিপক্ষ দলের ওপর আমাদের বিরূপ মনোভাব। দল যেকোনো একটা যে কেউ করতেই পারে, এটা যার যার বোধের ব্যাপার, আদর্শের ব্যাপার। কিন্তু সম্মানের জায়গাটা থাকতে হবে, অন্য দল করছে বলেই সে যে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। একে অন্যকে আঘাত করা থেকেও বের হতে হবে। সম্মান কাউকে দিলে সেটা নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যায়।
আমি একটা দল করছি মানেই অন্য দলের শীর্ষ নেতাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই করতে হবে তা নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বদলাতে হবে।
অনেকেই মনে করে, ছাত্ররাজনীতি করা মানেই শিক্ষকদের সাথে ঝামেলা করতেই হবে। শিক্ষকরা আমাদের বাবা-মায়ের জায়গায়। তাদেরকে স্থান দিতে হবে মাথার উপরে। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিতে হবে যথাযথভাবেই।
রাজনীতি হচ্ছে নীতির রাজা, অবশ্যই রাজার নীতি নয়। কিন্তু এটাকে খুব সুন্দর করে রাজার নীতি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কথায় বলে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়, কিন্তু আমাদের সমাজে একদম তার উল্টোটা চলে। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে আমরা কিছুই ভাবতে পারি না। রাজনীতি এখন রূপ নিয়েছে ‘ভাই নীতিতে’।
এখন কেন এই অবস্থা? তার একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। মূলত অনেকেই চায় না ছাত্ররাজনীতি ভালো পর্যায়ে আসুক। তাহলে অনেকের অসৎ উপায়ে উপার্জন/চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ছাত্ররা হচ্ছে একদম নির্মল আত্মার, তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। তাদের মাঝে শুধু একবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আবেগটুকুকে জাগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা আর করবে কে? একই নেতা দুইটা, চারটা গ্রুপ লালনপালন করেন। গোপনে তিনি সব গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করেন, আর সব গ্রুপের কাছেই অন্য গ্রুপের নামে গালাগালি করেন, অন্যদের দমিয়ে রাখার জন্য নির্দেশ দেন। অনেকেই বলেন, ছাত্ররাজনীতি ভালো ছেলেরা করে না। কিন্তু এই কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। অবশ্যই ভালো ছেলেরা রাজনীতিতে আসে। কিন্তু তারা টিকতে পারে না, জগতে খারাপের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তখন ভালোরা টিকতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। আর নেতারাও বুদ্ধি করে যোগ্যদের নেতৃত্বে আনেন না। এমন কাউকে নেতৃত্বে আনেন যারা তার গুণগান ছাড়া কিছুই বুঝবে না। ভালো ছেলেটাকে পদ না দিয়ে পদ দিবেন যেই ছেলেটা তিনি গাড়ি থেকে নামলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে নেন, বাসা থেকে বের হলে জুতাটা এগিয়ে দেন, নেতার বাসায় বাজার করে দেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতার অবস্থান আসমানে উঠিয়ে দেন তারাই হয় নেতা, তারাই পায় যোগ্য পদ।
দোষ কি শুধুই বড়দের? ছাত্রদের কোনো দোষ নাই? অবশ্যই আছে, কবিতায় শুনেছি, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকালে হবে? তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে। আমরা কেন ঘুমিয়ে আছি? আমাদের বিচার বুদ্ধি বিবেচনা সব কেন ধ্বংস হয়ে যাবে? আমরা আমাদের নিজেদের বিবেক দিয়ে কেন পথ চলতে পারি না? রুখে তো কাউকে দাঁড়াতেই হবে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মুখ থুবড়ে পড়তে হবে আমাদের। ছাত্রনেতা যদি ধর্ষণ মামলার আসামি হয়, হত্যা মামলার আসামি হয়, টেন্ডারবাজি করে বেড়ায় তাহলে তো অন্য একটা ভালো ছেলে রাজনীতিতে আসবে না, তাহলে রাজনীতি খারাপদের দখলেই থেকে যাবে। যখন একজন ছাত্রনেতা ক্লাসে ফার্স্ট হবে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হবে তখন ছাত্ররাজনীতিতে আসার জন্য কাউকে আর নিজে থেকে ডাকতে হবে। আমাদের সুন্দর কাজই তখন ছাত্ররাজনীতির সাইনবোর্ড হয়ে দাঁড়াবে।
ছাত্ররাজনীতি যুগে যুগে মানুষকে বিজয় এনে দিয়েছে, দেশকে স্বাধীনতা আনতে সাহায্য করেছে, পৃথিবীজুড়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৪৮ জার্মানি-অস্ট্রিয়ার, ১৯৫৫ সালে আর্জেন্টিনা, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায়, ১৯৬৪ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ায় ছাত্ররা গেয়েছিল জনতার গান। আমাদের দেশেও কম যায়নি ছাত্ররা। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ এই সবগুলো বিজয়েই অগ্রগামী ছিল ছাত্ররা। তাহলে এখন কেন দেশকে পিছিয়ে যাওয়ার যাত্রায় অগ্রগামী হবে ছাত্ররা।
আমাদের ভাবতে হবে নিজেদের, নিজেদেরকেই শুধরাতে হবে। আমাদেরকে কেউ ভুল পথে নিয়ে গেলেই তো আর আমরা ভুল পথে যেতে পারি না। একটা বিপ্লব আবার দরকার। যেই বিপ্লব কোনো বিশেষ কিছুর বিরুদ্ধে নয়, এই বিপ্লব ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার বিপ্লব।
মাহবুব নাহিদ: লেখক, কলামিস্ট

