ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এবারের জি-২০ (The G20) সামিটে অনেক বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখান থেকে চুম্বক অংশ লেখার চেষ্টা করেছি-
১. ইউক্রেন বিষয়ে ঐক্যমত: জি-২০ সামিটের মাধ্যমে ইউক্রেন বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছা এবং এই বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার দায়িত্ব ভারতের ওপর ন্যস্ত ছিল। যা ভারত পারবে মর্মে সারা বিশ্ব প্রত্যাশা করেছিল। জি-২০ এর সদস্য দেশগুলো ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। যেখানে রাশিয়া ও চীন ইউক্রেন বিষয়ে কোনো আলোচনা হোক তা চায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছিল যুদ্ধের জন্য ‘ইউক্রেনকে নিন্দা জানানো হোক।’
বিজ্ঞাপন
নিন্দা জনানোর বিষয়টা ভারতের নেতৃত্বে সর্বসম্মতিক্রমে বাদ দেওয়া হয়। নয়া দিল্লি এই ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি এবং এতদ বিষয়ে কোনো যৌথ বিবৃতিও আদায় করতে পারেনি।
অবশেষে সব সদস্য দেশের মধ্যে সমঝোতা হয় এবং এর মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়। এটা সবাই বিশ্বাস করত যে, ভারত কখনোই ইউক্রেন বিষয়ে যৌথ বিবৃতি আদায় করতে পারবে না। কিন্তু এতদ বিষয়ে ভারতের আন্তরিক প্রচেষ্টা বিশ্বে তাদের পররাষ্ট্রনীতির সুনাম বৃদ্ধি করবে।
২. আফ্রিকান ইউনিয়ন জি-২০ এর নতুন স্থায়ী সদস্য হওয়া: ৫৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত আফ্রিকান ইউনিয়ন আজ জি-২০ এর স্থায়ী সদস্য। এটি ভারতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল, যেটি নিজেকে গ্লোবাল সাউথের ভয়েস হিসেবে ভারত উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে এবং সার্থক হয়েছে। নয়া দিল্লি এখন উন্নয়নশীল দেশের উদ্বেগগুলোকে ঠেলে দেওয়ার রেকর্ডটি দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করতে পারে, যা জি-২০ তে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য পদ পাওয়া তার প্রমাণ।
৩. অর্থনীতি: অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই জি-২০ সামিটকে দুটি প্রধান জিনিসের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে- (ক) ঋণ মুক্তি এবং (খ) আন্তর্জাতিক ঋণদান প্রতিষ্ঠানের সংস্কার।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা থেকে গৃহীত ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি, দরিদ্র দেশগুলোর ওপর উচ্চ ঋণের মাত্রা, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য গরিব দেশগুলো প্রতিনিয়ত লড়াই করছে।
পূর্বে গরিব দেশগুলোর সাথে একসাথে কাজ করা এবং তাদের বেইল আউট (একটি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া থেকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা/দেশ কর্তৃক বিতরণকৃত ঋণ) করার প্রচেষ্টা (G20 সহ) ধীরগতিতে হয়েছে।
এই জি-২০ সামিটের মাধ্যমে ঘানা, জাম্বিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো নতুন দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য সম্মতি পেয়ে ভারত এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছে। প্রধান বিষয়টি ছিল বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদান প্রতিষ্ঠানের সংস্কার
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এবং দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য আরও অর্থ ধার দেওয়া দরকার এবং তারা আরও অর্থ ধার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই জি-২০ সম্মেলনে দেশগুলো এই বৈশ্বিক ঋণদান সংস্থাগুলোর সংস্কারের জন্য প্রধান সুপারিশগুলো বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে।

সংস্থাগুলোর সংস্কার করা হলে, ঋণদান সংস্থাগুলো পরবর্তী দশকে বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার অনুমতি দেবার সক্ষমতা অর্জন করবে। এর পাশাপাশি, এই জি-২০ সামিটে অত্যন্ত জটিল বৈশ্বিক কর প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সংস্কারের সিদ্ধান্তের অগ্রগতি হয়েছে।
৪. প্রযুক্তি: প্রথমত, জি-২০ এর সদস্য দেশগুলো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’র লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত সফলভাবে ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে (মূলত আধার, ইউপিআই) বৈশ্বিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতকে উন্নয়নশীল বিশ্বে ভারতের তৈরি ‘প্রযুক্তি সমাধান’ রফতানি করতে সাহায্য করবে।
এটি বৈশ্বিক ‘প্রযুক্তি সমাধান’ প্রদানকারী হিসেবে এর ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে।
৫. জলবায়ু পরিবর্তন: এই জি-২০ সামিটের ভেতর দিয়ে ভারতের নেতৃত্বাধীন, গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্সও আজ চালু হয়েছে। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য: ‘পেট্রোলে ইথানল ব্লেন্ডিং ২০% পর্যন্ত নেওয়ার জন্য বিশ্ব-স্তরে একটি উদ্যোগ নেওয়া।’ এটি বাস্তবায়ন হলে, এটি হবে ভারতের বৃহত্তর ক্লিন এনার্জি পুশের অংশ এবং যা বিদেশের মাটিতে ভারতের আরও উন্নতিতে সাহায্য করবে।
জি-২০ সামিটে যা হয়নি: এই জি-২০ সামিটে রাশিয়া ও চীনের প্রেসিডেন্ট অনুপস্থিত থাকায় ইউক্রেন বিষয়ে কোনো যৌথ বিবৃতি আসেনি। বিশ্বে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং আমেরিকার কারণে জলবায়ু সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় যা এই জি-২০ সামিটে আলোচনা হয়নি।
শেষ কথা: ভারত বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে অনুষ্ঠিত এই জি-২০ সামিট তার প্রমাণ। সব মিলিয়ে জি-২০ তে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি, আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থার সংস্কার এবং গরিব দেশগুলোর সাথে একসাথে কাজ করার ঘোষণা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।
লেখক: এজিএম ও ম্যানেজার, বিডিবিএল, কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চ, ঢাকা

