শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দালালদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস!

খলিলুর রহমান
প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩১ এএম

শেয়ার করুন:

দালালদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস!

পাসপোর্ট করতে নিয়মমাফিক আবেদন করবেন, তারপর ফিঙ্গার প্রিন্টসহ অন্যান্য কাজ সম্পাদন শেষে নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্ট সংগ্রহ করবেন। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে এই নিয়মে পাসপোর্ট পেতে আপনাকে বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন হতে হবে। কারণ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সর্বত্রই দালালদের দৌরাত্ম্য। দালালের মাধ্যমে চুক্তিতে কাজ করলে আপনি পাসপোর্ট সহজেই পেয়ে যাবেন, এমনকি নির্ধারিত সময়ের আগেও পেয়ে যেতে পারেন। দালালদের বাইরে গেলে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস যেন দালালদেরই নিয়ন্ত্রণে।

গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসের সামনে যান ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদক। সাথে সাথেই কয়েকজন যুবক তাকে ঘিরে ধরেন। পাসপোর্ট করবেন কি না জানতে চান। এ সময় পরিচয় গোপন রেখে ওই প্রতিবেদক জানান, তিনি নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবেন। একাধিক দালাল চক্র তখন এই প্রতিবেদককে নিজেদের জিম্মায় নেওয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে হায়দার নামে এক দালালের সাথে কথা বলা শুরু করেন ওই প্রতিবেদক।


বিজ্ঞাপন


দালাল হায়দার তাদের কম্পিউটারের দোকান রয়েছে জানিয়ে সেই দোকানে যাওয়ার কথা বলেন। পরে প্রতিবেদককে পাসপোর্ট অফিসের উল্টো দিকে ফুটপাতে নিয়ে যান এবং সেখানে রাখা একটি চেয়ার ও টেবিল দেখিয়ে বলেন, এটাই আমার দোকান। তবে পুলিশ আজ দোকান বসাতে দিচ্ছে না। তাই আমরা অন্য জায়গায় কাজ করছি। কোনো সমস্যা হবে না। টাকা দেন, সময় মতো আপনার কাজ হয়ে যাবে।

পরে আজ নয়, আগামী সপ্তাহে পাসপোর্ট আবেদন করব- এমন তথ্য জানালে সাথে সাথে মানিব্যাগ থেকে একটি কাগজের টুকরা বের করেন। সেখানে তার নাম ও মোবাইল নম্বর লেখা রয়েছে। দালাল হায়দার বলেন, আপনে যেকোনো সময় এসে ফোন দিলেই আমি কাজ করে দেব।

পাসপোর্ট অফিসের সামনে নারী দালাল চক্রের উপস্থিতিও লক্ষ্যণীয়। এক পর্যায়ে নারী দালাল চক্রের সদস্যদের সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। হাওয়া বেগম নামে এক নারী দালাল পাসপোর্ট করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি পুরুষ দালাল চক্রের সদস্যদের সাথেই পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে এই প্রতিবেদককে আগারগাঁও কাঁচা বাজারের ভেতরে একটি কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যান। সেখানে রাসেল হোসেন নামের এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। রাসেল তার ফোন নম্বর দিয়ে পাসপোর্ট করার নিয়ম জানিয়ে দেন।

আগামী সপ্তাহে পাসপোর্টের আবেদন করার আশ্বাস দিলে রাসেল এই প্রতিবেদককে বলেন, নতুন পাসপোর্ট ১০ বছরের জন্য করলে ১৪ হাজার টাকা লাগবে। মাত্র ১২ দিনে পাসপোর্ট ডেলিভারি। ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য আলাদা তারিখ দেওয়া হবে না। যেদিন আবেদন করবেন সেদিনই ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে যাবেন। ১২ দিন পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।

শুধু রাসেল, হাওয়া বেগম ও হায়দার নয়, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে দালাল চক্রের শতাধিক সদস্যকে দেখা গেছে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এসব দালালরা ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে আবার আগের কাজই করছেন।

একাধিক ভুক্তভোগী জানান, দালাল ছাড়া আবেদন জমা দেয়া হলে সার্ভার নষ্ট, অফিসার আসেননি, ছবিতে সমস্যা, জন্মতারিখ ভুল- এমন হাজারও সমস্যা তুলে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দেশের প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশ রয়েছে। বাইরে থেকে দালালরাই নিয়ন্ত্রণ করে পাসপোর্ট অফিসগুলো। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে পড়তে হয় নানা হয়রানিতে।

আরও পড়ুন: খালি নির্ধারিত বোর্ড, পোস্টারের ছড়াছড়ি দেয়ালে

কিবরিয়া নামে এক ভুক্তভোগী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি গত বছর দালাল চক্রের সদস্য ছাড়াই পাসপোর্ট করেছি। কিন্তু পাসপোর্ট পেতে প্রায় ছয় মাস লেগেছে। তাই এবার ছোট ভাইয়ের পাসপোর্ট করার জন্য দালাল চক্রের মাধ্যমে আবেদন করতে বলেছি। এতে বাড়তি টাকা গেলেও সময়মতো পাসপোর্ট পাওয়া যাবে বলে মনে করেন কিবরিয়া।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পাশে কাঁচাবাজারে শ’খানেক কম্পিউটারের দোকান রয়েছে। দালাল চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনকে এসব দোকানে নিয়ে যান। এছাড়া ফুটপাতেও কিছু ভাসমান দোকান আছে দালালদের।

এদিকে সম্প্রতি গ্রাহক হয়রানি ও ঘুষ দাবির অভিযোগ যাচাইয়ে রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ছদ্মবেশে গিয়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা। অভিযানকালে পাসপোর্ট অফিসে চরম অব্যবস্থাপনার সত্যতা পান দুদক কর্মকর্তারা। এমনকি তারাও রক্ষা পাননি দালালদের খপ্পর থেকে।

>> আরও পড়ুন: হাসপাতাল যেন ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’

এ বিষয়ে দুদক উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানে গ্রাহক হয়রানি ও ঘুষ দাবির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক প্রধান কার্যালয়ের দুই সদস্যদের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। টিমের সদস্যরা প্রথমে ছদ্মবেশে অফিসের সামগ্রিক সেবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে টিম পরবর্তীতে কমিশনে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুদক টিমের সদস্যরা পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশের সময় মূল ফটকেই বেশ কয়েকজন দালাল তাদের ‘সেবা’ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে ওই অফিসের কিছু কর্মচারী এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অফিসের ভিতরে কয়েকজন সেবাপ্রার্থী দালালদের দৌরাত্ম্য, চরম অব্যবস্থাপনা এবং অর্থের বিনিময়ে সিরিয়াল লাইনের সামনে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন এবং সরেজমিনে এসব অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক টিম।

দুদক টিম পাসপোর্ট অফিসের ১০৩নং কক্ষে গিয়ে এনআইডি ভেরিফিকেশনের এক কর্মচারীকে ৪০ মিনিট ধরে অনুপস্থিত পায়। ৩০৪নং কক্ষে গিয়ে কোনো লাইন বা সিরিয়াল না মেনে ইচ্ছেমতো বায়োমেট্রিক করার চিত্র দেখতে পায়। পরবর্তীতে দুদক টিম কার্যালয়ের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে।

এসব বিষয়ে জানতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও ইমিগ্রেশন) সেলিনা বানুকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে অধিদপ্তরের ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক সাইদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দালাল চক্রের বিষয়টি বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করা হয়। তারা এসে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা আবারও একই কাজ করে।

কেআর/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর