এখনও রেশ কাটেনি বৈশ্বিক মহামারির। এরমধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে কৃষি অর্থনীতিতে। চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে দাম বেড়েছে ইউরিয়া সারের। বেড়েছে ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দামও। ব্যয় বাড়ছে চাষাবাদে। বাড়তি খরচে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকের কপালে। এতসব বিপত্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আবারও আমন চাষে প্রস্তুতি ছিল কৃষকদের। কিন্তু ফসল ঘরে তোলার আগেই প্রকৃতির বিরূপ আচরণে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার তাদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে— ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ৩১ জেলায় বিভিন্ন ফসলের ১০ হাজার ২০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে যা দাঁড়ায় ৩৪৭ কোটিতে। কম নয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যাও। মাথায় হাত পড়েছে প্রায় দেড় লাখ কৃষকের। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে আমন ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর, সবজি ২ হাজার ৮০০ হেক্টর, পানবরজ ৮৮ হেক্টর (তবে টাকার দিক থেকে পানবরজ সবচেয়ে বেশি ১৬২ কোটি টাকা)। ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছে ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির আমন ধান। এর বাইরে ধানের চিটা পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
বেসরকারি হিসাবে— আমন ধান চাষে এবার কয়েক লাখ হেক্টর কম হচ্ছে। আর দেরিতে হওয়ায় ফলনও আশানরূপ হবে না। বন্যা ও খরার কারণে এবার আউশ ও আমন আবাদ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হয়েছে। বিশেষ করে আমন আবাদ দেরিতে হওয়ায় ফলনও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হবে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই দেশে চালের দাম বেশি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে ব্যর্থ হয়ে সরকারিভাবেই ১০ লাখ টনের বেশি আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু চলমান আউশ ও আমনের ফলন কম হলে খাদ্যনিরাপত্তা আরও হুমকিতে পড়বে। বাড়বে চালের আমদানি নির্ভরতা। চলমান ডলার সংকটে যা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সরকারের জন্য।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক ব্যবহারের ৭০ শতাংশেরও বেশি হয় শুধু বোরো মৌসুমে। একইভাবে সেচের ব্যবহার লাগে বেশি। কিন্তু সেচযন্ত্রের প্রধান জ্বালানি ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়বে উৎপাদন খরচ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) তথ্য ধরে হিসাব করলে ডিজেলের দাম বাড়ায় শুধু সেচের জন্য বোরোতে কৃষকের খরচ বাড়বে প্রায় ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এরসঙ্গে সার, বীজসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার বোঝাতো আছেই। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয় কেজিপ্রতি ছয় টাকা ও চলতি মাস থেকে সব ধরনের বীজের দাম বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ। আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত কৃষি উপকরণের দাম বহাল থাকলে তা ধানের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে আসবে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ। কারণ তখন বোরো ধানের চাল বাজারে আসবে।
এদিকে চলতি বছর ধান উৎপাদন কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) চলতি মাসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের ধান, গম ও অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমবে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমবে ধানের উৎপাদন।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সূত্রমতে— ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে মোট ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হতে পারে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা মেইলকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ফসলের যেভাবে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা হয়নি। তবে সামগ্রিকভাবে যে প্রভাব পড়েছে সেটাও এক ধরনের ক্ষতি। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সকল উইংকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুষিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবীদ প্রফেসর গোলাম হাফিজ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশের ফসল উৎপাদনের ধারাবাহিতা রক্ষা করতে হলে সব ধরনের আবহাওয়া সহিষ্ণু ফসলের জাত উৎপাদন করতে হবে। তবেই ঝড়, খরা, বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা কমবে।
টিএ/এইউ