সংসদ নির্বাচনের বাকি আর সাড়ে ১৪ মাস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
ভোটকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ঢেলে সাজাতে নানা হিসাব-নিকেষ করছে সরকার। সেজন্য প্রশাসনের বদলি-পদায়নের বিষয়টি অনেকটা আলোচনায় এসেছে। কিছুদিন আগে একযোগে ৪০ জেলার পুলিশ সুপার পদে বদলি করা হয়। মেয়াদ পূর্তির আগেই গত রোববার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেনকে। গতকাল বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় তিন জেলার পুলিশ সুপারকে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের ঘটনায় প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
বিজ্ঞাপন
প্রশাসনে মকবুল আহমেদের মতো আরও এমন অনেকে তালিকায় আছেন, যাদের অবসরে পাঠনোর সম্ভাবনা আছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। কারণ হিসেবে এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, অসদাচরণ আবার কখনো কখনো সরকার বিরোধীদের সঙ্গে যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে বলা হচ্ছে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও বদলির লক্ষ্যে তালিকা হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর অংশ হিসেবে কর্মকর্তাদের সম্পর্কে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: এবার তিন এসপিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাল সরকার
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেওয়ায় আলোচনায় উঠে আসেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক অবসরের এক বছরের কম সময়ের আগে তথ্যসচিবকে বাধ্যতামূলক বিদায় জানানোর বিষয়টিকে বড় সংকেত মনে করছেন প্রশাসন-সংশ্নিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্র বলছে, মকবুল হোসেন একা নয়, প্রশাসনের ভেতর যারা দুর্নীতি করছে এবং বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনে এমন আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা সর্বোচ্চ পদ ব্যবহার করে দুর্নীতি, বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন মহল মনে করে, আমলারা যত ব্যাপক পরিমাণে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এ কারণেই প্রশাসনের ভূমিকা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
শুধুমাত্র যে আর্থিক দুর্নীতি তাই নয়, এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোভাপন্ন নয়, বিএনপি জামায়াতের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন এরকম অনেক ব্যক্তিও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে জায়গা করে নিয়েছেন। তারা বাইরে আওয়ামী লীগ, ভেতরে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ফাইলের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে অন্য মহলের কাছে চলে যাচ্ছে। এসব তথ্য পাচারের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে শোনা যায়। অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের অন্তত ৫ থেকে ৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে এবং অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আরও একাধিক সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত চলছে।
আরও পড়ুন: তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেন অবসরে
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন কীভাবে ঢেলে সাজানো হবে ও গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে কারা আসছেন তা নিয়ে হিসাব কষছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। সরকারের পক্ষ থেকে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। উপজেলা প্রশাসন থেকে সচিবালয় পর্যন্ত সবখানে চলছে নানা গুঞ্জন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে ৪০ জেলায় পুলিশ সুপার পদে পদায়ন করা হয়েছে। এখন চলছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তালিকা তৈরির কাজ। চলতি বছরের শেষ নাগাদ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও বদলির লক্ষ্যে তালিকাগুলো তৈরি হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২১ ও ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি জেলায় জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে আছেন। সেখানে ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। যারা ২১ ও ২২ ব্যাচের হয়েও জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তাদের অচিরেই বদলির আওতায় আনা হতে পারে। গত বছর ২৪তম বিসিএসের কয়েকজন জেলা প্রশাসক হয়েছেন। চলতি বছর ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক করার প্রক্রিয়া চলছে। আর ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের আগামী বছরের শুরুতে জেলা প্রশাসক করার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ইউএনওর দায়িত্ব পালন করছেন ৩০, ৩১, ৩৩ ও ৩৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। আগামী নির্বাচনের আগে (বিসিএস) ৩৪তম ব্যাচের অবশিষ্ট কর্মকর্তা এবং ৩৫ ও ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনও পদের জন্য বাছাইয়ের কাজ চলছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব/সচিব পদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক কর্মরত আছেন। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই সংখ্যা ৭৬। তাদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ও স্পেশাল ব্যাচের একজন করে, ১৯৮৪ ব্যাচের পাঁচজন, ১৯৮৫ ব্যাচের দুজন, ১৯৮৬ ব্যাচের ১২ জন, নবম ব্যাচের ১০ জন, দশম ব্যাচের ২৫ জন এবং একাদশ ব্যাচের ২০ জন রয়েছেন। এদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ ১৩ জন চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। চলতি বছরের ১০ জন সচিব ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২৬ জন সচিব আগামী বছর (২০২৩) অবসরে যাবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বরে।
আরও পড়ুন: প্রশাসন সাজাতে হিসাব কষছে সরকার
বাধ্যতামূলক অবসরের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়ে গেলে সরকার যে কাউকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠাতে পারে। আবার কোনো কর্মকর্তা স্বেচ্ছায়ও এ সময়ের পর চাকরি থেকে অবসর নিতে পারেন।
তিনি বলেন, বাধ্যতামূলক অবসরের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়াও বিএনপি সরকারের আমলেও এমন অবসরে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে।
আরও পড়ুন: ১০ এডিসিসহ ডিএমপির ২৪ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি
নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সেদিক বিবেচনায় সরকার চাইবে প্রশাসনকে সেট করতে। তবে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের উচিত সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া।
টিএ/এমআর