২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হিসাব কষছেন সরকার। অনেকটা নড়েচড়ে উঠছে প্রশাসনের বদলি-পদায়নের বিষয়টি। এছাড়া চলতি বছরের শেষে এবং আগামী বছরের শুরুতে প্রশাসনের শীর্ষ বেশ কয়েকটি পদ শূন্য হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন কি ভাবে ঢেলে সাজানো হবে ও গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে কারা আসছেন তা নিয়ে হিসাব কষছেন সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে থেকে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রার্থীদেরও চলছে জোর চেষ্টা তদবীর। উপজেলা প্রশাসন থেকে সচিবালয়-বঙ্গভবন পর্যন্ত সবখানে চলছে নানা গুঞ্জন। অপরদিকে সম্প্রতি মাঠ প্রশাসনের বেশকিছু কর্মকাণ্ডে বিব্রত সরকারের উচ্চ মহল। দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে, চলছে তদন্ত।
সম্প্রতি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতার ট্রফি ভেঙে ফেলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেন, যে ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বর্তমান সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য সবার কাছে দোয়া চান, যার ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা, কক্সবাজারের টেকনাফ, ফরিদপুরের বোয়ালমারী ও নওগাঁর বদলগাছীসহ আরও কয়েকটি স্থানে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচরণে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এ ধরনের আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এমন আচারণে বিব্রত সরকারের উপর মহল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৪০ জেলায় পুলিশ সুপার পদে পদায়ন করা হয়েছে। এখন চলছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তালিকা তৈরির কাজ। চলতি বছরের শেষ নাগাদ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও বদলির লক্ষ্যে তালিকাগুলো তৈরি হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২১ ও ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি জেলায় জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে আছেন। সেখানে ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। যারা ২১ ও ২২ ব্যাচের হয়েও জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তাদের অচিরেই বদলির আওতায় আনা হতে পারে। গত বছর ২৪তম বিসিএসের কয়েকজন জেলা প্রশাসক হয়েছেন। চলতি বছর ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক করার প্রক্রিয়া চলছে। আর ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের আগামী বছরের শুরুতে জেলা প্রশাসক করার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ইউএনওর দায়িত্ব পালন করছেন ৩০, ৩১, ৩৩ ও ৩৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। আগামী নির্বাচনের আগে (বিসিএস) ৩৪তম ব্যাচের অবশিষ্ট কর্মকর্তা এবং ৩৫ ও ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনও পদের জন্য বাছাইয়ের কাজ চলছে।
অপরদিকে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের শেষের দিকে। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই পদে কে আসছেন তা নিয়ে বঙ্গভবন ও সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে নানা গুঞ্জন। তারা মেলাচ্ছেন হিসাব-নিকাশ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদও শূন্য হচ্ছে। কে হচ্ছেন পরবর্তী জনপ্রশাসন সচিব তা নিয়ে বেশ জোরেশোরে চলছে আলোচনা। প্রশাসনে রদবদল নিয়মিত কাজের অংশ। তবে উচ্চ পর্যায়ের পদে নিয়োগ ও রদবদলের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় এবারের নিয়োগ বা বদলির বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল।
সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই সিনিয়র সচিবসহ ১০ জন সচিব আগামী ডিসেম্বরে চাকরি শেষে অবসরে যাবেন। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ তিন সচিবের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ফলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব এবং ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদ শূন্য রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত দুই থেকে তিনজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব/সচিব পদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক কর্মরত আছেন। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই সংখ্যা ৭৬। তাদের মধ্যে বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ও স্পেশাল ব্যাচের একজন করে, ১৯৮৪ ব্যাচের পাঁচজন, ১৯৮৫ ব্যাচের দুজন, ১৯৮৬ ব্যাচের ১২ জন, নবম ব্যাচের ১০ জন, দশম ব্যাচের ২৫ জন এবং একাদশ ব্যাচের ২০ জন রয়েছেন। এদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ ১৩ জন চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। চলতি বছরের ১০ জন সচিব ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২৬ জন সচিব আগামী বছর (২০২৩) অবসরে যাবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বরে।
নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশে কোনো সরকারই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। যে কোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। আর আমাদের দেশে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সেই দিক বিবেচনায় সরকার চাইবে প্রশাসনকে সেট করতে। তবে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের উচিত সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রশাসনে রদবদল নিয়মিত কাজের অংশ। তবে উচ্চ পর্যায়ের পদে নিয়োগ ও রদবদলের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় এবারের নিয়োগ বা বদলির বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল।
টিএ/এএস