শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

লঞ্চ কেটে লোহার দরে বিক্রি করছেন মালিকরা

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

লঞ্চ কেটে লোহার দরে বিক্রি করছেন মালিকরা
সব মিলিয়ে ছোট বড় সাত থেকে আটটি লঞ্চ কাটা হচ্ছে। ছবি: ঢাকা মেইল

একসময় বরিশাল থেকে ঢাকায় নৌপথে যাত্রী আনা-নেওয়া করা হতো কাঠের তৈরি ছোট লঞ্চে। ষাটের দশকে যাত্রা শুরু করে কাঠের দোতলা লঞ্চ। এর এক দশক পর কাঠের বদলে জায়গা করে নেয় স্টিলবডির লঞ্চ। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে এই খাত। আকার-আকৃতির পাশাপাশি আসতে থাকে বৈচিত্র্য। বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে যাত্রীসেবায় যোগ হয় নতুন নতুন সেবা। ফলে শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, সারাদেশের মানুষের কাছে স্বস্তি এবং আয়েশি যাত্রার বাহন হয়ে ওঠে লঞ্চ। কিন্তু এক পদ্মা সেতু যেন সবকিছু বদলে দিয়েছে। ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম নৌপথের এই সেবাখাতটি।

গত জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললেও বর্তমানে খুবই নাজুক অবস্থার মুখোমুখি লঞ্চখাত। তাই প্রতিনিয়ত লোকসান দিতে থাকা মালিকরা এখন লঞ্চ কেটে লোহার দামে কেজি হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন লঞ্চ শ্রমিকরা। কারণ পুরো খাত বন্ধ হয়ে গেলে একসঙ্গে বেকার হয়ে পড়বেন কয়েক হাজার শ্রমিক।


বিজ্ঞাপন


লঞ্চ মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী কমে এলেও কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন পর রোটেশন মেনে লঞ্চ চালানোও শুরু করেছিলেন তারা। কিন্তু নতুন বিপদ হয়ে আসে হঠাৎ তেলের দাম বেড়ে যাওয়া। তেলের পেছনে প্রতি ট্রিপে বড় অংকের টাকা চলে যাওয়ায় মালিকরা চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। তাই বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিনের যত্নে গড়া বাহন কেটে বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। কেটে বিক্রি করার কারণে দামও অনেক কম পাচ্ছেন মালিকরা।

আরও পড়ুন: টিকে থাকার চেষ্টা, যাত্রী ভাগ করে লঞ্চ চলছে মাওয়ায়

বিলাসবহুল অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক ও এফবিসিসিআই পরিচালক নিজামউদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ যাত্রী কম নিয়ে চলাচল করছে লঞ্চগুলো। আবার তেলের দাম বাড়ার কারণে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতি রাউন্ড ট্রিপে দুই-তিন লাখ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে লঞ্চ চালানো যাবে না।’


বিজ্ঞাপন


কয়েক বছর আগে আওলাদ হোসেন নামের একজন লঞ্চ মালিকের কাছে বরিশাল-ঢাকা রুটে চলা কীর্তনখোলা-১ লঞ্চ বিক্রি করেছিলেন কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস। পরে লঞ্চটির নাম পরিবর্তন করে এমভি কামাল-১ রাখা হয়। বর্তমানে বিলাসবহুল সেই লঞ্চটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মালিক আওলাদ হোসেন।

শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘লঞ্চটি পুরানা মডেলের ছিল, যা এই সময়ের সঙ্গে যায় না। এরমধ্যে শুরু হলো পদ্মা সেতু। পরে আবার বাড়ল তেলের দাম। যাত্রী নেই, কিন্তু লস ঠিকই আছে। সব মিলে এই সেক্টরের অবস্থা ভালো না। কারণ রাস্তাঘাট হচ্ছে। সামনে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চালু হলে আরও খারাপ অবস্থা হবে। তাই লঞ্চটি এভাবে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।’

এভাবে বিক্রি করায় কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে এই লঞ্চ মালিক বলেন, ‘আসল টাকা তো আর পাবো না। মোটামুটি পাবো। তবে সব কাটা শেষ হলে খরচপাতি দেওয়ার পর বোঝা যাবে আসলে কয় টাকায় বিক্রি হয়েছে।’

লঞ্চটির মূল মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস জানিয়েছেন, কীর্তনখোলা-১ লঞ্চের দাম ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা। কয়েক বছর আগে এটি বিক্রি করেছেন। এখন সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা পেতে পারেন।

lonch2

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেরাণীগঞ্জের ওপারে নদীতে রেখে কাটা হচ্ছে এসব লঞ্চ। আবার এপারে শ্বশ্মানঘাট এলাকাতেও দিনরাত কাটা হচ্ছে এসব লঞ্চ। ‘মানামী’ নামের আরও একটি লঞ্চ অর্ধেক নির্মাণ করার পর তাও কেটে ফেলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ছোট বড় সাত থেকে আটটি লঞ্চ কাটা হচ্ছে।

জানা যায়, লঞ্চের এসব স্টিল নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কিছু মিল মালিক কিনছেন। আবার অন্য লোকজনও কিনে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। রোলিং মিলগুলোতে নিয়ে গলিয়ে রড, স্টিল তৈরি করা হবে।

সংকটের শুরুটা যেখান থেকে

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮টি রুটে চলাচল করে লঞ্চ। কম করে হলেও ২০০ লঞ্চ চলে এসব রুটে। এরমধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের বিলাসবহুল লঞ্চ চলে বরিশাল-ঢাকা রুটে। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল করে ১৮টি লঞ্চ।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ভোলা অঞ্চলের রুটগুলো ছাড়া অন্যসব রুটেই চলছে যাত্রী সংকট। গৌরনদী, শরীয়তপুর, নড়িয়াসহ অনেক রুটে তো লঞ্চ চলাচল বন্ধই হয়ে গেছে। ঢাকা-বরিশাল রুটে দিনে চলাচল করা জনপ্রিয় লঞ্চ সার্ভিসও বন্ধ হয়ে গেছে পদ্মা সেতু চালুর কিছু দিনের মাথায়। এখন যে সাত-আটটি লঞ্চ কেটে কেটে লোহার দরে বিক্রি করছেন তার সবই এসব রুটের।

এদিকে গত জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চ মালিকদের ভাবনা ছিল, কিছুদিন বড় ধরনের চাপ থাকলেও পরবর্তী সময়ে তারা যাত্রী পাবেন। কিন্তু মাঝের ঈদ ছাড়া বাকি সময় অনেকটাই ফাঁকা চলাচল করেছে লঞ্চ।

আরও পড়ুন: বিকল্প খুঁজছেন সদরঘাটের কুলিরা!

অন্যদিকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে গত আগস্টে দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এরপর আরেক দফায় ধাক্কা খায় লঞ্চ মালিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তেলের দাম বাড়ার আগে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে তাদের খরচ হতো ছয় লাখ ২০ হাজার টাকা। দাম বৃদ্ধির পর সেটি গিয়ে আট লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যাত্রী কম থাকায় প্রতিবার রাউন্ড ট্রিপে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত তাদের লোকসান হচ্ছে।

lonch3

যদিও যাত্রীদের বড় হিসাব সময় নিয়ে। কারণ রাতে চলা লঞ্চে ভোরে বরিশাল পৌঁছালেও সড়ক পথে এই সময়ে আসা-যাওয়া করা সম্ভব। ভাড়াও তুলনামূলক কম। ফলে সময় বাঁচাতে অনেক নিয়মিত যাত্রীরাও লঞ্চ যাত্রা বাদ দিয়েছেন।  

ভাড়া কমিয়েও সুফল মেলেনি

এদিকে যাত্রী সংকট শুরুর পর লঞ্চ মালিকরা যাত্রী টানতে নির্ধারিত ভাড়া থেকে বেশ টাকা কম নেওয়া শুরু করে। বিশেষ করে ঢাকা-বরিশাল রুটের সিংহভাগ লঞ্চ ভাড়া কমায়। তিন তলাবিশিষ্ট লঞ্চে ডেকের ভাড়া ৩৫০ থেকে কমিয়ে করা হয় ২০০ টাকা। চার তলা লঞ্চগুলোর ক্ষেত্রেও ১০০ টাকা ভাড়া কম নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে কমেছে ভিআইপি, বিজনেস ক্লাস, কেবিন এবং সোফার ভাড়া।

কিন্তু যেখানে কেবিন পাওয়া দুষ্কর ছিল সেখানে কয়েকশ টাকা ভাড়া কমিয়েও অর্থেক কেবিনে যাত্রী পায়নি বরিশালের রুটের মালিকরা। ফলে ভাড়া কম নিয়েও যাত্রী টানতে পারেনি লঞ্চ।

এদিকে গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয় রোটেশন করে লঞ্চ চলাচল। ১৮টি লঞ্চের মধ্যে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে প্রতিদিন মোট ছয়টি লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক পক্ষ। দুই প্রান্ত থেকে তিনটি করে লঞ্চ প্রতিদিন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এতেও তেমন পরিবর্তন নেই যাত্রী চলাচলে।

কী ভাবছেন লঞ্চ মালিকরা

লঞ্চ যাদের আয়ের অন্যতম খাত ছিল সেই মালিকরা এখন অন্য ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলে ট্রেন চলা শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন তারা।

আরও পড়ুন: লঞ্চে সন্তান জন্ম দিলেন নারী, আজীবন যাতায়াত ফ্রি

অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যাত্রী সংকটের কারণে রোটেশন পদ্ধতি শুরু হয়েছে। ভেবেছিলাম সংকটের কিছুটা হলেও সামাধান হবে। কিন্তু তা হয়নি। তিন লঞ্চ মিলেও হাজার যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। অর্ধেকের বেশি কেবিন খালি ছিল। এভাবে চললে ব্যবসা ধরে রাখার সুযোগ নেই।’

আর কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একজন মালিক যখন লঞ্চ কেটে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তখন এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। অর্থাৎ সামনে কতদিন কয়টা লঞ্চ চলতে পারবে তা বলা পুরোপুরি অসম্ভব।’

এই অবস্থায় কীভাবে এই খাত বেঁচে থাকবে সেজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের সহযোগিতাও চেয়েছেন মালিকরা। 

বিইউ/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর