শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

বিকল্প খুঁজছেন সদরঘাটের কুলিরা!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০২২, ১০:৩৫ এএম

শেয়ার করুন:

বিকল্প খুঁজছেন সদরঘাটের কুলিরা!

৪৭ বছর বয়সী হেমায়েত উদ্দিনের ১৩ বছরই কেটেছে সদরঘাট এলাকায়। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার হেমায়েত নৌপথের যাত্রীদের মালামাল ওঠানো নামানোর কাজ করে দিব্যি সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্তু গত জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে জীবিকায় টান পড়েছে। কারণ লঞ্চের যাত্রী আগের থেকে যে অনেক কম। 

শুধু হেমায়েতই নন, তার মতো প্রায় শতাধিক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নিবন্ধিত শ্রমিকের বেশিরভাগেরই একই অবস্থা। কারণ যাত্রী খড়ায় আগের মতো কাজ নেই। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে সংসার চালানোয় হিমশিম খেতে হচ্ছে এসব শ্রমিকদের। তাই এদের কেউ কেউ বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছেন বলে জানিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


আরো পড়ুন: স্বরূপে ফিরেছে সদরঘাট, লঞ্চে লঞ্চে মানুষের ঢল

dhaka

যদিও কথিত ইজারাদারের নামে ও শ্রমিক সংগঠনের নামে যেসব শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের কিছুটা ভালো চলছে। কারণ বিআইডব্লিউটিএ’র নিবন্ধিতরা পোশাকধারী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ দেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এর বাইরে যারা সদরঘাটে কুলির কাজ করছে তারা বেশিরভাগই বেপরোয়া। তাদের উপর যেন কারো কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। এ কারণে তারা যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছামত টাকা আদায় করার সুযোগ পাচ্ছে।

সম্প্রতি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় নিবন্ধিত একাধিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন বাস্তবতার কথা জানা গেছে। তারা বলছেন, আগে প্রতিদিন ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা আয় করা গেলেও এখন তা নেমে এসেছে অর্ধেকে। 


বিজ্ঞাপন


গত জুন থেকে তাদের আয়ে এমন ভাটা পড়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে লঞ্চে যাত্রী যেমন কম আসছে। মালামালও কম আসছে। ফলে বেশিরভাগ সময় এসব ঘাট শ্রমিকদের অলস সময় পার করেই কেটে যায়। 

dhaka

ঘাট শ্রমিক হেমায়েত উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগের চেয়ে আয় অর্ধেক কমছে। কিন্তু খরচ তো বাড়ছে। যে পরিমাণ যাত্রী আর মালামাল ঘাট দিয়ে যায় তার চেয়ে শ্রমিক বেশি। এইজন্য কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। এই কাজ বাদ দিয়ে অন্য কোথায় যাবো সেই সুযোগও নাই।’

ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৪৫ টি রুটে দৈনিক লঞ্চ চলাচল করে। এই নদীবন্দর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের এলাকাগুলো যেমন- পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠী, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন গন্তব্যে লঞ্চ ও স্টিমার ছেড়ে যায়। 

অন্যদিকে নৌপথে পণ্য আনা-নেয়া, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সব আড়ত এই সদরঘাট এলাকার আশপাশে। যে কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু এই ঘাট। দিনভর এখানে লঞ্চ আসা-যাওয়া করে। অন্যদিকে নৌকায় করে এপার-ওপার যাত্রী আনা নেয়াও চলে ভোর থেকে রাত অবধি। 

আর লঞ্চকে আনা নেয়া করা পণ্য বহনের জন্য কয়েকশ কুলি আছেন সরদঘাটে। কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ঘাটে কাজ করেন। এদের হাতে যাত্রীদের লাঞ্ছিত হওয়া, বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ বেশ পুরানো।

জানা গেছে, জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগসহ আরো কিছু সংগঠনের নামে এই ঘাটে প্রায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। এরা যা আয় করেন তার নির্দিষ্ট একটি অংশ ইজারাদারদের দিতে হয়। এদের কেউ লাল পোশাকে, কেউ আবার হলুদ পোশাকে ঘাটে শ্রমিকের কাজ করেন। 

ঘাট সূত্রে জানা গেছে, একেকটি ঘাটের আবার কুলি সর্দার আছেন। যাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন সাধারণ শ্রমিকরা। রোস্টার অনুযায়ী শ্রমিকরা যারা কাজ করেন তারা পণ্য বহনের বিনিময়ে যে টাকা পান সর্দারকে একটা বড় অংশ দিতে হয়। যার ভাগ ইজারাদারদের কাছেও পৌঁছে যায়।

যে কারণে এই শ্রমিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে মালামাল বহন করা, অতিরিক্ত টাকা দাবি করে থাকে। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে সদরঘাটে।

বিশেষ করে লঞ্চে মোটরসাইকেল নিয়ে আসলে তাদের সঙ্গে সাতসকালে শ্রমিকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। কিন্তু এসব যেন দেখার কেউ নেই।

অন্যদিকে যারা বিআইডব্লিউটি’র নিবন্ধিত শ্রমিক আছেন তারা দুই শিফটে ঘাটে কাজ করেন। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা। আরেক গ্রুপ সাতটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ঘাটে কাজ করেন। 

আরো পড়ুন: এক রুম থেকে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে পুরো সদরঘাট!

যদিও যাত্রী হয়রানি, ব্যাগ টানা ও জুতা চোর চক্র থেকে যাত্রীদের রক্ষা, ঘাটে অবৈধ দোকান বসিয়ে টাকা তোলা বন্ধ এবং ইজারাদারদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদায়ে জটিলতা দূর করতে সদরঘাটের ইজারা প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ইজারা প্রথার বদলে ২০১০ সালের জুলাই থেকে এ ঘাটে নতুন পদ্ধতি কার্যকর করারও ঘোষণা ছিল। বিআইডব্লিউটিএ তাদের নিবন্ধিত শ্রমিকদের দিয়ে ঘাটটি পরিচালনা করেছিল।

জানা যায় পরবর্তিতে ২০১৪ সালে ৯০ জনের মতো শ্রমিককে নিবন্ধন দেয়া হয়। তারা নির্দিষ্ট পোশাকে তাকে সদরঘাটে দায়িত্ব পালন করেন।

নিয়ম অনুযায়ী পণ্যবহনের নির্ধারিত ফি পরিশোধের কথা থাকলেও নিবন্ধিত শ্রমিকরাও যাত্রীদের কাছ থেকে চুক্তি করে টাকা নেন। কখনো কখনো মালামাল বহনের পর যাত্রীরা খুশি হয়ে যা দেন তাও নেন কেউ কেউ। যদিও ইজারা বাতিল সংক্রান্ত আলোচনার সময় তৎকালিন নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছিলেন, কেবলমাত্র নিবন্ধিত এসব শ্রমিকই সদরঘাটে কাজ করতে পারবে।

dhaka

বিষয়টি নিয়ে বিআইডাব্লিউটি’র নিবন্ধিত শ্রমিকরা বলছেন, ৫২০ টাকার পোস্টাল অর্ডারের খরচ হিসেবে নিয়ে তাদের নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। অন্য শ্রমিকরা কাজ করায় তারা কাজ কম পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাদের জন্য নূন্যতম ভাতার ব্যবস্থা করার দাবিও তুলছেন।

সাবেক নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান ও তৎকালিন বিআইডব্লিউটি’র চেয়ারম্যান এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে দাবি শ্রমিকদের।

আরো পড়ুন: স্বরূপে ফিরেছে সদরঘাট, লঞ্চে লঞ্চে মানুষের ঢল

শহিদুল ইসলাম নামের একজন নিবন্ধিত শ্রমিক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোথাও গিয়ে যে অন্য কাজ করবো সেই সুযোগ, বয়সও নাই। তারপরও জীবন বাঁচাতে অন্য কিছু করা যায় কিনা ভাবতেছি।’

এদিকে নিবন্ধিত শ্রমিকদের বাইরেও অন্য যারা ঘাটে কাজ করছেন, যাদের হাতে যাত্রীরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন বিআইডাব্লিউটি’র যুগ্ম পরিচালক মো.আলমগীর কবীর।

শ্রমিকদের ভাতা কেন্দ্রিক কোনো চিন্তা ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় জানা নেই। সিদ্ধান্ত হলে বলা যাবে।’

এদিকে ইজারার বিষয়ে বিআইডাব্লিউটি’র যুগ্ম উপ-পরিচালক (ইজারা) মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ইজারা বন্ধ হওয়ার পরে আর চালু হয়নি। এবছর টেন্ডার হওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্থগিত আছে।’

বিইউ/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর