- অগ্নিসন্ত্রাস ও চোরাগোপ্তা হামলা বৃদ্ধির শঙ্কা
- জামিনে থাকা সন্ত্রাসীদের নিয়ে উদ্বেগ
- সিইসিসহ কমিশনারদের বিদেশি নম্বর থেকে হুমকি
- অতিরিক্ত নিরাপত্তা চায় ইসি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই রাজধানীতে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে দেশের দুটি উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা হয়। এসব ঘটনায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিক এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
ইসি সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ ডিসেম্বর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। একই দিন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে রিকশাযোগে যাওয়ার সময় শরিফ ওসমান হাদিকে মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তি অনুসরণ করে। একপর্যায়ে তারা তাকে বহনকারী অটোরিকশার কাছে গিয়ে মাথার কাছে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়। এসব ঘটনার পর থেকেই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ইসি সচিবালয়ের সূত্র বলছে, সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনার পর কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। ভোটের দায়িত্বে থাকা সব কর্মকর্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, তারপরও আমাদের মধ্যে থেকে ভয় যাচ্ছে না। নির্বাচনের জন্য নানা কাজ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় ধরে অফিসে থাকতে হয়। বাসায় ফেরার সময় কমিশনের স্টিকার গাড়ি থেকে খুলে বাসায় ফিরছি। এ রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে কমিশন আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, অতি দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
>> আরও পড়তে পারেন
প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন এলে গণনা করা হবে না পোস্টাল ব্যালট
মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর তাদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইসির সিনিয়র সচিব মাঠপর্যায়ের সব কর্মকর্তার সঙ্গে ভার্চুয়াল (জুম) সভা করেন। সভায় সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলা এবং নির্বাচন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে। রোববার (১৪ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বিজিবি, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন—নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসন্ত্রাসের তৎপরতা বাড়তে পারে।
বৈঠকে হামলার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নাকি বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ—তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানতে চান, দিনে-দুপুরে একজন প্রার্থীকে হামলার পর হামলাকারীরা কীভাবে পালিয়ে গেল।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত চেকপোস্ট ও তল্লাশি থাকলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।
জবাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানান, ঘটনার পর রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
অগ্নিসন্ত্রাস ও চোরাগোপ্তা হামলা বাড়ার শঙ্কা
ইসি বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে অগ্নিসংযোগ, চোরাগোপ্তা হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, চোরাগোপ্তা হামলা কোনো বড় পরিকল্পনার অংশ কি না, নাকি এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা—তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যদি এটি বড় পরিকল্পনার অংশ হয়, তাহলে অতীতে তা প্রতিরোধে কোনো ঘাটতি ছিল কি না এবং হামলাকারীরা যেভাবে পালিয়ে গেছে, সেখানে কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
>> আরও পড়তে পারেন
পাঁচ শর্ত মাথায় রেখে নির্বাচন আয়োজন করবে ইসি
তিনি বলেন, বার্তাটি খুবই স্পষ্ট—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মাঠপর্যায়ে যে চোরাগোপ্তা হামলাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর প্রকৃতি নিরূপণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এসব প্রতিহত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য ছিল ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেটি ব্যর্থ করতেই এই বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জামিনে থাকা সন্ত্রাসীদের নিয়ে উদ্বেগ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে জামিনে মুক্ত চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া আচরণ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে ইসি।
কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, আগে গ্রেফতার হওয়া অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী জামিনে মুক্ত হয়ে সমাজে অবস্থান করছে। তাদের চলাচল ও কার্যক্রম সীমিত করতে কীভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিটারেন্স তৈরি করতে বেশি চেকপোস্ট বসানো, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা এবং অবৈধ অস্ত্র ও হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে কথা হয়েছে। আমাদের জানানো হয়েছে, ‘রেবেল হান্ট’ অপারেশনের দ্বিতীয় ধাপ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের সমন্বয় জোরদার করা হচ্ছে, বিশেষ করে সীমান্ত ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায়।
সিইসিসহ কমিশনারদের বিদেশি নম্বর থেকে হুমকি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে না—এমন হুমকি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের বিদেশি নম্বর থেকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসি সূত্র।
>> আরও পড়তে পারেন
বছরের ব্যবধানে ভোটার স্থানান্তর বেড়েছে দ্বিগুণ
সূত্র জানায়, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই কমিশনারদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।
এক কমিশনার জানান, ইসির সিনিয়র সচিবকে মেসেজ দিয়ে বলা হয়েছে— ‘নির্বাচন হবে না, বড় ধরনের হামলা করা হবে।’
অতিরিক্ত নিরাপত্তা চায় ইসি
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ মাঠপর্যায়ের কার্যালয় এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পাওয়া তিন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা চেয়েছে ইসি।
জানা যায়, বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য গাড়িসহ পুলিশি এসকর্ট থাকলেও নির্বাচনকালীন সময়ে আরও একটি গাড়িসহ অতিরিক্ত এসকর্ট চাওয়া হয়েছে। এছাড়া চার কমিশনার ও সিনিয়র সচিবের বাসভবন ও অফিসে যাতায়াতসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য বলা হয়েছে।
ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ও প্রতীক বরাদ্দ হবে ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনি প্রচার চলবে ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১২ ফেব্রুয়ারি।
এমএইচএইচ/এএস

