রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পাঁচ শর্ত মাথায় রেখে নির্বাচন আয়োজন করবে ইসি

মো. মেহেদী হাসান হাসিব
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

EC
নির্বাচন কমিশন। ছবি- ঢাকা মেইল
#মাঠ পর্যায়ে ক্যাপ স্থাপনই বড় চ্যালেঞ্জ, ইসিকে সেনাবাহিনী 
#ভোটে ভুয়া ফোনকল শনাক্তে কার্যকর ব্যবস্থা চায় বিমান বাহিনী 
# সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনে ৩৫ সিদ্ধান্ত ইসির

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি। সেই লক্ষ্যে চলতি মাসের ১০ কিংবা ১১ তারিখে তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে এরই মধ্যে ইসি তাদের মূল লক্ষ্য ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। 


বিজ্ঞাপন


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা ও নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত বৈঠক শেষে সংস্থাটি জানিয়েছে, একটি ‘ভালো নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে তারা পাঁচটি মূল শর্তকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। শর্তগুলো পূরণ করা গেলেই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এছাড়া আসন্ন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমন্বিতভবে ৩৫টি সিদ্ধান্তও নিয়েছে সংস্থাটি। 

গত ২৭ নভেম্বর নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ইসির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান ও তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকে অংশ নেওয়া ইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৈঠকে ভোটারদের নিরাপত্তার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একটি ভালো নির্বাচনের জন্য পাঁচ শর্তের কথা বলা হয়েছে, যা পূরণ হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে ইসি। এছাড়া পরিকল্পিত নাশকতা, কালো টাকা, ক্রস-বর্ডার সংযোগ এবং সাইবার হামলাকে শুরুতেই মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


বৈঠকে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ভোটাররা যেন কেন্দ্রে এসে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন— এই নিশ্চয়তা দেওয়াই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের মূল উদ্দেশ্য। ভোটকেন্দ্র, ভোটার এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে ‘টপ প্রায়োরিটি’ হিসেবে। মাঠপর্যায়ে স্ট্রাইকিং ফোর্সকে দৃশ্যমান রাখার পাশাপাশি কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে জুরিসডিকশন নির্বিশেষে নিকটস্থ বাহিনীকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘ইসির ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সব বাহিনীকে অবিচল পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে।’

পাঁচ শর্তের কথা উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ (অব.) বলেন, ‘ভালো নির্বাচন’ বলতে পাঁচটি বিষয় নিশ্চিত করাকে বোঝায়- যোগ্য প্রার্থীর নির্ভয়ে প্রার্থী হতে পারা, ভোটারের স্বাধীনভাবে কেন্দ্রে এসে প্রভাবমুক্ত ভোটদান, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ভোটগ্রহণ পরিবেশ, প্রদত্ত ভোটের সঠিক গণনা এবং ভোট গণনার স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা। এ পাঁচটি শর্ত পূরণ করাই আমাদের সব কার্যক্রমের লক্ষ্য।’

তিনি জানান, ‘ইতোমধ্যে বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ, মাঠপর্যায়ের পুনর্গঠন এবং আন্তঃবাহিনী সমন্বয় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে বিচ্ছিন্ন ঘটনাও বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দিতে পারে।’

পরিকল্পিত নাশকতা, কালো টাকা, ক্রস-বর্ডার সংযোগ এবং সাইবার হামলাকে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেন ইসি সানাউল্লাহ। তিনি জানান, এ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উঠে এসেছে ভুয়া তথ্য, ডিপফেক, সাইবার আক্রমণ ও সমন্বিত ডিজইনফরমেশন ক্যাম্পেইন।

EC2
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের একটি মুহূর্ত।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী ‘মনিটরিং ও কোঅর্ডিনেশন সেল’ এবং আলাদা ‘সাইবার অপারেশনাল সেল’ গঠনের প্রস্তাব দেন ইসির এই কর্মকর্তা। জেলা-উপজেলায়ও সমন্বয় সেল গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

মাঠ পর্যায়ে ক্যাপ স্থাপনই বড় চ্যালেঞ্জ: ইসিকে সেনাবাহিনী

আসন্ন নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে সেনাবাহিনী। ইসির সঙ্গে বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি জানান, মোবাইল ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হলে পর্যাপ্ত যানবাহন সাপোর্ট জরুরি। এজন্য সেনাবাহিনীকে যানবাহন রিকুইজিশনের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। 

এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ (সশস্ত্র বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখন, কীভাবে এবং কোন সীমার মধ্যে শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, সেই নির্দেশিকা) নির্ধারণ অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।

সেনাপ্রধানের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, মাঠপর্যায়ে ক্যাম্প স্থাপনে আবাসন সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশাধিকারের ক্ষমতা দেওয়ার অনুরোধও জানান তিনি।

ভোটে ভুয়া ফোনকল শনাক্তে কার্যকর ব্যবস্থা চায় বিমান বাহিনী 

আসন্ন নির্বাচনে বিপুল পরিমাণে ভুয়া ফোনকল আসার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি জানান, এ ব্যাপারে কার্যকর শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জরুরি। এছাড়া পার্বত্য এলাকায় নির্বাচন সামগ্রী হেলিকপ্টারে পরিবহনের পরিকল্পনা আগে থেকেই জানাতে হবে।

সভায় যা বলেছেন অন্যান্য বাহিনীর প্রতিনিধিরা

নৌবাহিনী প্রতিনিধি জানান, চার হাজার সদস্য নির্বাচনি দায়িত্বে থাকবে। দুর্গম এলাকায় জাহাজের মাধ্যমে অপারেশন করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আনসারের ডিজি বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালনে তফসিল ঘোষণার পরপরই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। স্ট্রাইকিং ফোর্সের ‘কিভাবে সাড়া দেওয়া হবে’ এবং ‘কখন সাড়া দিতে হবে’- এসব বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা এবং সমন্বিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করার ব্যাপারে মত দেন তিনি।

ডিএমপি কমিশনার জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যাতায়াতে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়ে। যেসব দফতরের গাড়ি নির্বাচনকালে ব্যবহৃত হয় না, তা বাহিনীগুলোর জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। এছাড়া প্রার্থীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চাহিদা বিবেচনায় জটিলতা বাড়ার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।

এনটিএমসির ডিজি নির্বাচনের সময় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও নিরাপদ ডেটা শেয়ারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কোস্টগার্ড সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রচারণা ও হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রতিনিধিরা রেড-ইয়েলো-গ্রিন জোনভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা, বিশেষ ব্যক্তিদের তালিকা, জেলা স্তরের সাইবার সিকিউরিটি সেল এবং সহিংসতার মাধ্যমে দাবি আদায়ের প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়নের পরামর্শ দেন।

র‍্যাবের মহাপরিচালক সভায় জানান, প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে তাৎক্ষণিক কৈফিয়ত তলব বা ব্যক্তিগত হাজিরার ব্যবস্থা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে অন্য কমিশনাররা যা বলেছেন

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ভোটকেন্দ্রে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে প্রিজাইডিং অফিসারই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো তাকে পূর্ণ সহায়তা করা।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ভালো নির্বাচনের বিকল্প নেই উল্লেখ করে বলেন, প্রতিযোগিতা থাকলে উত্তেজনার সম্ভাবনা থাকে, তাই প্রার্থী ও কর্মীদের পর্যবেক্ষণ, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং আচরণবিধি মানা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভোটের আগে বাহিনীর দৃশ্যমান উপস্থিতি আস্থা বাড়ায় এবং ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনশৃঙ্খলা তদারকি করবেন। 

তিনি জানান, বাহিনীর মহড়া সন্তোষজনক চলছে। নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তাই ইসির শক্তি, যার মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ বলেন, রাজনৈতিক দল, স্থানীয় নেতা বা জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে কোনো আপ্যায়ন বা সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না। প্রিজাইডিং অফিসারসহ সব ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা সুবিধা গ্রহণ না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান তিনি।

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনে ৩৫ সিদ্ধান্ত ইসির

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ভোট সুষ্ঠু করতে ৩৫টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনে সমন্বিত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা। ভোটার, ভোটকেন্দ্র ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। সব বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কোঅর্ডিনেশন সেল গঠন। নিকটস্থ বাহিনীর তাৎক্ষণিক রেসপন্স নিশ্চিত করা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিড অর্গানাইজেশন হিসেবে একটি পরিপত্র জারির নির্দেশ। ডিপফেক, মিসইনফরমেশন ও সাইবার আক্রমণ রোধে স্বতন্ত্র সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন।

এছাড়া জেলা-উপজেলায় সমন্বয় সেল গঠন। বাহিনী-টু-বাহিনী কমান্ড নয়, সেল কাঠামোতে সমন্বয়, নিজস্ব চেইন অব কমান্ড বজায় রাখা। স্ট্রাইকিং ফোর্সের দৃশ্যমানতা ও মোবাইল ভিজিলেন্স বাড়ানো।

আরও রয়েছে- রিজার্ভ ফোর্সের কনটিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি। থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের ওপর ভিত্তি করে রেড-ইয়েলো-গ্রিন জোনভিত্তিক ডেপ্লয়মেন্ট পরিকল্পনা।

এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে বলে আশাপ্রকাশ করছে নির্বাচন কমিশন।

এমএইচএইচ/এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর