কখনো ছিনতাই, আবার কখনো সড়ক দুর্ঘটনা। দিনের আলো পেরিয়ে রাত হলে রাজধানী ঢাকার সড়কে বাড়ে নানা ঝুঁকি। রাত হলে গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সড়কে চোখে পড়ে ছিনতাইকারীদের আনাগোনা। এতে তটস্থ থাকেন পথচারীরা। কখনো কখনো ছিনতাইকারীদের চাওয়া অনুযায়ী জিনিসপত্র না দিলে পড়তে হয় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কবলে।
এদিকে রাতে ঢাকার সড়কে থাকে না পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। কোনো কোনো সড়কে থাকে না বাতি। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলো হয়ে উঠে ছিনতাইকারীদের হটস্পট। রাতের বেলা কিছু কিছু মোড়ে পুলিশ থাকলেও তারা পথচারীদের সহায়তায় এগিয়ে আসে না বলে অভিযোগ আছে। যার ফলে ঘটে রাজধানীতে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি মতো ঘটনা।
বিজ্ঞাপন
সড়কের মোড় ছিনতাইকারীদের দখলে
অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত চেকপোস্টেও পুলিশ সদস্যদের দেখা মেলে না। কোথাও আবার টহলের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও গাড়ি রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সড়কের মোড় ও সড়ক থাকে ছিনতাইকারীদের দখলে।
সম্প্রতি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ব্যক্তিগত কাজে আমি মোহাম্মদপুর গিয়েছিলাম। কাজটা শেষ করতে দেরি হয়ে যায়। সাড়ে ১২টার দিকে আমি সংসদ ভবন মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম গাড়ির জন্য। অনেক সময় অপেক্ষা পরও গাড়ি পেলাম না। এরমধ্যে কয়েকজন এসে আমাকে বলে তোর কাছে যা আছে দিয়ে দে।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি দিতে না চাইলে দেশীয় অস্ত্র দেখায়। আমি ফোন ও সঙ্গে থাকা কিছু টাকা দিয়ে দিই। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে টাকা বা ফোনের চেয়ে আমার জীবন গুরুত্বপূর্ণ।
মশিউর রহমান বলেন, এত অনিরাপদ একটি দেশ হতে পারে না। রাতে পুলিশের দেখা পাইনি। আমরা নিরাপদ ঢাকা চাই। আর কাউকে যেন এভাবে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে না হয়।
রাত ১২টার পর অনিরাপদ ঢাকা
দিনের বেলায় ঢাকায় চুরি, ছিনতাইকারীদের তৎপরতা কম থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে বাড়ে হিংস্রতা। রাত যত গভীর হয় ঢাকার সড়কে ততই বাড়ে অপরাধ। বিশেষ করে রাত ১২টার পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলো ছিনতাইকারী, মাদকাসক্ত ও নানা ধরনের অপরাধীদের অভয়রাণ্য হয়ে ওঠে। রাতের বেলায় গুরুত্ব সড়কগুলোতেও তেমন থাকে না পুলিশ। কয়েকটি মোড়ে পুলিশের দেখা পেলেও তাদের ভূমিকা থাকে নিষ্ক্রিয়।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিদেশ থেকে আসা স্বজনকে অভ্যর্থনা জানাতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেন নিউমার্কেটের বাসিন্দা তারিক আনাম (ছন্মনাম)। সরাসরি বিমানবন্দরের গাড়ি না পাওয়ায় প্রথমে মানিক মিয়া এভিনিউতে বাস দিয়ে যান। পরে সেখান থেকে ফার্মগেট দিয়ে তেজগাঁও মোড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করেন। সেখানে যাওয়ার পর ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার শিকার হন। তিনি যখন মোড়ে দাঁড়ানো তখন পথচারীর জিনিসপত্র কেড়ে নেয় এবং মারধর করে ছিনতাইকারীরা।
জানতে চাইলে তারিক আনাম ঢাকা মেইলকে বলেন, সেদিন তেজগাঁও মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন, তাও তারা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। একটু দূরে অপরাধটা ঘটলেও কিছু করেননি। উল্টো আমাকে বলে মোবাইল সাবধানে রাখেন, ছিনতাইকারীরা আছে আশপাশে। মোবাইল পকেট থেকে বের করলে টান দিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তারিক আনাম বলেন, ওই সময়ে তেজগাঁও মোড়ে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা ছিল না। চতুর্দিক থেকে গাড়ি যাতায়াত করছে। কিছু কিছু গাড়ি বেপরোয়া, মোড়েও থামে না, জোরে চালিয়ে যায়। রাতে সড়কে ট্রাফিক না থাকার কারণে এই অবস্থা। রাতেও সড়কে শৃঙ্খলা প্রয়োজন। যত্রতত্র গাড়ি যাতায়াত করে। কখনো কখনো চতুর্মুখী সংঘর্ঘ হওয়ার উপক্রম হয়।
সম্প্রতি কয়েক দিন সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, গুলিস্তান, পল্টন, তেজগাঁও, সাইন্সল্যাব, নীলক্ষেত মোড়সহ গুরুত্ব মোড়গুলোতে থাকে না পুলিশ। থাকলেও উপস্থিতি খুবই কম। রাতে সড়কে থাকে না ট্রাফিক ব্যবস্থা। অনেক সড়কে নেই পর্যাপ্ত আলোও। কিছু কিছু বাতি থাকলেও তা নষ্ট। যার ফলে দুর্ঘটনা, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা
রাতে সড়কে ট্রাফিকব্যবস্থা না থাকায় বেপরোয়া থাকে ট্রাকচালক ও বাইকাররা। যার ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। প্রায়ই ঘটে প্রাণহানির মতো ঘটনা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে গত এক বছরে সড়কে ২২৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। পথচারীরা বেশি হতাহত হয়েছেন যানবাহনের ধাক্কায় বা চাপায়। যাদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৬০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটছে রাতের বেলায়।
সংগঠনটি তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, গত বছর সড়কে নিহতদের ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার ঢাকা মেইলকে বলেন, পুলিশের লোকবল কম থাকায় রাতের বেলা ঠিক মতো শিডিউল দেওয়া যায় না। রাতে ট্রাফিকব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য দিনের মতো লোকবল প্রয়োজন, সেটা তো আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। আর দুর্ঘটনা বেশির ভাগ রাতেই ঘটে।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার প্রবণতাই বেশি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। দ্রুতগতির এসব যানবাহন চালকদের বেশির ভাগই অসুস্থ ও অদক্ষ। এদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর কারণে যারা সতর্কভাবে মোটরসাইকেল চালান তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজধানীতে আরও নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।’
এসএইচ/জেবি
