শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শীতের রাতে ঢাকার ফুটপাথে বেঁচে থাকার লড়াই

মাহফুজুর রহমান
প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

winter
শীতের রাতে ঢাকার ফুটপাথে বেঁচে থাকার লড়াই। ছবি: ঢাকা মেইল

ঢাকার শীত খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু যখন নামে অসহায় মানুষের শরীরে তার কামড়টা গভীরভাবে লাগে। আনুষ্ঠানিক আবহাওয়ার হিসেবে তাপমাত্রা খুব কমে না, কিন্তু ফুটপাতে থাকা মানুষদের কাছে সেই তাপমাত্রাই হয়ে ওঠে ভয়ানক। রাজধানীর ব্যস্ত নগরজীবনের ভিড়ে তাদের অস্তিত্ব যেন চোখেই পড়ে না। কিন্তু রাত গভীর হলে, দোকানের শাটার নামলে, গাড়ির শব্দ কমে এলে তখন উন্মোচিত হয় এক ভিন্ন ঢাকা; যেখানে ঠান্ডা হাওয়া আর অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনকেই হুমকি দেয়।

মগবাজারের ফ্লাইওভারের নিচে মজিবুর রহমান নামের একজন পুরোনো এক কম্বল গায়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। কম্বলের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে থাকা হাত দুটো দেখে বোঝা যায়, তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আর ঠান্ডার শক্তির মধ্যে চলছে এক অসম লড়াই। তিনি বললেন, ‘দিনে যা পাই, রাতে তা দিয়েই চলতে হয়। শীতে সমস্যা আরেকটু বেশি। কম্বল কিনতে গেলে ৪০০–৫০০ টাকা লাগে, টাকা কোথা থেকে পাব?’


বিজ্ঞাপন


পথশিশু রিমন (১২) বলে, ‘আমি রাতে কারও দোকানের সামনে ঘুমাই। শীতে কষ্ট বেশি হয়। অনেকে পুরোনো কাপড় দেয়, তখন হয়ত আমাদের ভাগে পড়ে। রাতে যখন সবাই ঘুমায়, তখন আমার ভয় লাগে—ঠান্ডা না হলে অন্য মানুষদের ভয়। তারপরও ঘুমাই, কী করবো? সকালে কাজ করতে হয়—বাজারে ব্যাগ টানি। শীতের রাতে মনে হয় আমার মতো বাচ্চাদের কেউ দেখে না।’

আরও পড়ুন

শীত মানে না পাতলা কম্বলে, উষ্ণতার খোঁজে ছিন্নমূলেরা

শহরের বিভিন্ন মোড়ে শীতের সঙ্গে লড়াই করে এমন মানুষের গল্প আছে, আর আছে নিঃশব্দ চোখের পানি। বাড্ডা, মহাখালী, সদরঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রতিটা জায়গায় শীতের রাতে মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নেয় ছোট্ট এক আশ্রয়ে। যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই, তাদের রাত্রি অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে আসে।

Dhaka2


বিজ্ঞাপন


একদল বৃদ্ধ মানুষ আছে, যারা কখনো নিজের পরিবার হারিয়েছে, কখনো পরিবারই তাদের হারিয়ে ফেলেছে সময় ও দূরত্বের হিসাবের বাইরে।

নীলক্ষেতে আয়ুব আলী (৬০) নামে এমন একজন বলেন, ‘তিন বছর ধরে এখানে আছি। আগে একটা দোকানে কাজ করতাম। শরীরটা খারাপ হবার পর আর কাজ পেলাম না। রাতে ঠান্ডায় ঘুম আসে না, আবার জ্বরও আসে।’

তিনি একটি পুরোনো কাঁথা গায়ে মুড়ে দেন রাতে, কিন্তু শীত তো আর কাঁথা দেখে চলে যায় না। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝে মাঝেই যেন জমে থাকা বরফের স্পর্শ লেগে থাকে।

আরও পড়ুন

এবার শীতে কাঁপুনি ধরাতে পারে ৮ শৈত্যপ্রবাহ 

শিশুদের কষ্টটাও কম নয়। শীতে ঠান্ডাজনিত অসুখ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই অসুস্থ হলেও ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই। ফুটপাথের মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই, নিরাপদ জায়গা নেই, এমনকি ছোটখাটো ওষুধের ব্যবস্থা থাকাও কোম্পানির সৌভাগ্য বলা যায়।

ফলাফল অনেকেই জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে প্রতি মুহূর্তে।

Dhaka3

আজিমপুর কবরস্থানের পাশে একজন মা বলেন, ‘আমার বাচ্চাটা দুই দিন ধরে ঠান্ডায় শীত-শীত করছে। গায়ে জ্বর এসেছে। কিন্তু ওষুধ কিনবো কীভাবে? খাবারের টাকাই ঠিকমতো হয় না।’

ঢাকার রাতের দৃশ্য বাইরে থেকে দেখতে যতই আলোকিত হোক, ফুটপাথের মানুষের কাছে সে আলো শুধু দূরের আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের জানালায় ঝুলে থাকা একরাশ ধোঁয়া।

তারা দেখে কারো গাড়ি এসে থামে রেস্তোরাঁর সামনে, কেউ উষ্ণ পোশাকে মোড়া, কেউ ফোনে হাসিতে ব্যস্ত। আর নিজেদের দেখে ঠান্ডা ভেজা বাতাসে নিঃশ্বাসের ধোঁয়া, পুরোনো কাঁথা, ভাঙা ফুটপাত, আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা।

আরও পড়ুন

‘ঠান্ডার চিন্তায় ঘরে থাকলে খাব কী’

এমনও আছে যে কেউ সাহায্য পেলে তা ভাগ করে খায়। কেউ যদি দুটি কম্বল পায়, দ্বিতীয়টি দিয়ে দেয় পাশের বৃদ্ধ মানুষকে। জায়গাটা ফুটপাত হলেও এই মানুষগুলো অমানবিক নয়। বরং কঠিন জীবন তাদের একে অপরের প্রতি আরও মানবিক করে তুলেছে।

Dhaka4

শীত ঢাকা শহরের ব্যস্ত মানুষদের কাছে হয়তো এক-দেড় মাসের একটি ঋতু। কিন্তু ফুটপাতের মানুষের কাছে তা এক ভয়ংকর বাস্তবতা যা বাঁচার সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে।

এই শহর সদরঘাটের ভিড়, নিউমার্কেটের কোলাহল, তেজগাঁওয়ের রাস্তাঘাট, গাবতলীর ধুলোমাখা পথ সব মিলিয়ে এক বিশাল জীবন চক্র। কিন্তু সেই চক্রের বাইরে পড়ে থাকা মানুষগুলো যেন ভুলে যাওয়া কোনো অধ্যায়।

তাদের রাতগুলো অন্ধকার, শীতল, আর অনিশ্চয়তায় ভরা তবু তারা বাঁচে এবং বেঁচে থাকার এই সংগ্রামটুকু যেন আমাদের সকলকে একটু থামিয়ে ভাবায় এই শহর কি সত্যিই নিজেদের সব মানুষকে সমানভাবে ধরে রাখতে পারে?

এম/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর