শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঐক্য স্থাপনে কতটা সক্ষম হলো ঐকমত্য কমিশন?

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ঐক্য স্থাপনে কতটা সক্ষম হলো ঐকমত্য কমিশন?
ঐক্য স্থাপনে কতটা সক্ষম হলো ঐকমত্য কমিশন?
  • জটিলতায় কমিশনের সুপারিশ 
  • ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে বিতর্ক
  • গণভোটের ক্ষণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি
  • সনদ সইয়ের পর বেড়েছে বিভক্তি
  • ভবিষ্যৎ সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই কমিশন জুলাই সনদ নিয়ে প্রস্তাবও সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বাস্তবায়নের আদেশ না থাকা, ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর অনুপস্থিতি এবং গণভোট নির্বাচনের আগে নাকি একই দিন সেই বিতর্ক বড় হয়ে সামনে এসেছে।


বিজ্ঞাপন


কমিশনের নথিতে ২৫টি দলের সই থাকলেও বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। নেতারা প্রতিদিনই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। এই অবস্থায় নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জনগণের মধ্যেও রয়েছে নানা শঙ্কা। ফলে ঐকমত্য কমিশন কতটা সফল হলো সেটা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শুরুতে যে প্রত্যাশা ছিল, মেয়াদ শেষে এসে সেখানে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। কমিশন কি জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, নাকি এটি দেশের রাজনীতিতে আরেকটি অসমাপ্ত উদ্যোগ হিসেবেই থেকে যাবে—এ নিয়ে চলছে আলোচনা। এখন সবাই তাকিয়ে আছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। সরকারই নির্ধারণ করবে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, নির্বাচন পদ্ধতি, সাংবিধানিক কাঠামোসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বসে কমিশন। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, বামজোটসহ অনেক দল নিজেদের প্রস্তাব জমা দেয়। দীর্ঘ আলোচনার পর ১৭ অক্টোবর ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে বহুল আলোচিত ‘জুলাই সনদে’। ২৮ অক্টোবর কমিশন সেই সনদ তুলে দেয় প্রধান উপদেষ্টার হাতে।

13


বিজ্ঞাপন


কিন্তু সনদ জমা দেওয়ার পরই শুরু হয় নতুন বিতর্ক। দলগুলো সই করলেও ‘নোট অব ডিসেন্ট’, বাস্তবায়নের নির্দেশ এবং গণভোট ইস্যুতে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ বলছে, সনদ বাস্তবায়ন হলে রাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরবে; আবার কেউ বলছে, বাস্তবায়ন না হলে সনদের কোনো মূল্যই থাকবে না। বেশ কয়েকটি দলের অভিযোগ, বাস্তবায়নের রোডম্যাপ না থাকায় সনদটি এখনো কাগজেই সীমাবদ্ধ।

সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াও মিশ্র। কেউ বলছেন, বিরোধী দলগুলো একসঙ্গে বসেছে—এটিই বড় অর্জন। তবে বাস্তব পরিবর্তন না আসায় হতাশাও বেড়েছে। নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটবে কি না, তা নিয়েই এখন সবার প্রশ্ন।

জুলাই সনদ ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থানে নির্বাচন নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কি না, সব দল অংশ নেবে কি না—এসব প্রশ্ন ঘুরছে জনমনে। একটি অংশ মনে করছে, বাস্তবায়ন না হলে জনমত সরকারের বিরুদ্ধে যাবে। অন্যদিকে কেউ কেউ আশাবাদী—সরকারের পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত আস্থা ফিরিয়ে আনবে।

কমিশনের সদস্যরা বলছেন, তাদের কাজ শেষ—এখন দায়িত্ব সরকারের। তাদের মতে, আলোচনা, সনদ তৈরি ও স্বাক্ষরই ছিল কমিশনের দায়িত্ব; বাস্তবায়ন সরকারের এখতিয়ার। সরকার চাইলে এখনই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ দিতে পারে, গণভোটের সময়সূচি নির্ধারণ করতে পারে এবং বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের কাঠামো গঠন করতে পারে। অর্থাৎ কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও সিদ্ধান্ত এখন সরকারের হাতে।

4

ঐক্যমত কমিশনের দাবি, তারা আলোচনার পথ খুলেছে, ২৫টি দলকে স্বাক্ষর করিয়েছে, সংলাপের সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছে এবং একটি সনদ তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা সেই আস্থার বড় অংশ কেড়ে নিয়েছে। এখন পুরো দেশ তাকিয়ে আছে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে—কাগজের ঐকমত্য বাস্তবে রূপ নেবে কি না।

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলছেন। গত বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের মধ্যে যে অনৈক্যের সুর দেখছি, এটা হতাশাব্যঞ্জক। এ তীব্র বিরোধের মধ্যে কীভাবে সমঝোতার দলিল পাস হবে, এটা খুব দুরূহ একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব নিয়ে কমিশন দুটি বিকল্প উপায় দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি বলছে, সরকারের আদেশ জারির এখতিয়ার নেই। দলটি চাইছে, সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক। জামায়াত ও এনসিপি এর আগে গণভোটের দাবি তুলেছে।

‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ না রাখায় বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছে। এটি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলেও মনে করে দলটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাম্প্রতিক একাধিক বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐক্যমত কমিশনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

14

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও বিএনপি হঠাৎ অবস্থান বদলেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। এদিকে জামায়াতের সাথে সুর মিলিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘বিএনপি বিবাহে রাজি হয়ে কাবিননামায় সই করেছে, এখন না বলার সুযোগ নেই।’ যদিও এনসিপি নিজেরাই এই সনদে এখনো সই করেনি।

গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেন, ‘গণভোটের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত চলছে।’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফি রতন বলেন, ‘গণভোট নির্বাচনের দিনই হওয়া উচিত।’

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘গণভোট আগে-পরে যেদিনই হোক, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে। কোনো ঝুঁকি নেই। নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুন্দর নির্বাচন উপহার দেবে।’ 

বিশ্লেষকদের মতে, কমিশন রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে পেরেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন ছাড়া সেই অর্জন টেকসই হবে না। তারা মনে করিয়ে দেন, আইনি কাঠামো ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছাড়া এই সনদ বাস্তব রূপ পাবে না।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অর্জন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন যেদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাতে পেরেছিল, সংসদ ভবনের সামনে, সেটি ছিল একটি রিমার্কেবল (অসাধারণ) অর্জন। যদি সেই সনদটি সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা যেত, তাহলে কমিশনের জন্য এটি এক অসাধারণ সাফল্য হতো। প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অতিরিক্ত বিষয়ও সেখানে সংযোজন করা যেত।’

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘তবে আমি মনে করি, যাই হোক বা যাই না হোক, যদি ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই কার্যক্রম শেষ করত, তাহলে সেটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিভেদের কারণে যখন তারা সরকারের কাছে সুপারিশ উত্থাপন করে, তখন মতপার্থক্য দেখা দেয়। এর ফলে ঐক্যবদ্ধ কমিশনের অর্জন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে।’

একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে কাজ করেছে—বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এটি একটি বড় অর্জন। এখান থেকে তারা জনগণের কাছেও ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। তবে বর্তমানে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কারণ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে কিছু মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণভোটের তারিখ ও নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে ভিন্নমতের কারণে সামান্য অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।’

তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি মনে করি, অদূর ভবিষ্যতে এই সংকট কেটে যাবে। সময়ের সঙ্গে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, মানুষ তত বেশি নির্বাচনমুখী হবে। ইতোমধ্যে এনসিপি ‘শাপলা কলি’ প্রতীক গ্রহণ করেছে। তাই কিছু মতবিরোধ থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমে যাবে।’

এএইচ/জেবি/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর