শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালেও অনেকে জানে না রাজুর ইতিহাস

মাহফুজুর রহমান
প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালেও অনেকেই জানে না রাজুর ইতিহাস
রাজু ভাস্কর্য (ইনসেটে রাজুর ছবি)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী জমায়েত হয়—আড্ডা দেয়, গান গায়, প্রতিবাদ সভা করে কিংবা নিছক সময় কাটায়। সেই প্রাণকেন্দ্রের মাঝখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য প্রতীক, রাজু ভাস্কর্য।

কিন্তু এ দৃশ্যের বেদনাদায়ক দিক হলো—যার জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভাস্কর্য, সেই মইন হোসেন রাজুকে আজ অনেকেই চেনে না। কেউ জানে এটা একটি প্রতিবাদের স্মারক, কেউ বলে ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক। কিন্তু রাজু নামের সেই তরুণের রক্তাক্ত গল্প আজ ম্লান হয়ে গেছে ধুলোমাখা স্মৃতির মতো।


বিজ্ঞাপন


১৯৯২ সালের মার্চ মাসের এক রোদঝলমলে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু যখন সহপাঠীদের সঙ্গে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মিছিলে স্লোগান তুলেছিলেন, তখন কেউ ভাবেনি সেই মিছিলই তার জীবনের শেষ স্লোগান হবে। গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সী এই তরুণ ছাত্র। তার মৃত্যুর দুই বছর পর নির্মিত হয় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য, যা আজও এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রতিবাদের প্রেরণা জোগায়।

রাজু কে ছিলেন: স্বপ্ন ও ছাত্র রাজনীতির প্রতীক

মইন হোসেন রাজু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী এবং পরিচিত ছিলেন তার নম্র স্বভাব, তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি ও সংস্কৃতি-চেতনার জন্য।

2


বিজ্ঞাপন


রাজুর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলায়। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রাজু ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পরিশ্রমী ও সচেতন। তার স্কুলজীবন কেটেছে লাকসাম সরকারি হাই স্কুলে, আর কলেজ জীবন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রাজু ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। তবে তার রাজনীতি ছিল সহিংসতাবিহীন, আদর্শনিষ্ঠ এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার পক্ষে। বন্ধুরা বলেন, রাজুর চোখে ছিল এক ‘অন্য বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন—যেখানে শিক্ষাঙ্গনে থাকবে না দখলদারি, অস্ত্রবাজি বা রাজনৈতিক সন্ত্রাস।

রাজু শুধু রাজনীতিক নন, তিনি ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমীও। টিএসসি এলাকায় কবিতা পাঠ, নাট্যচর্চা আর বই পড়ার আসর ছিল তার প্রিয় জায়গা। এক সহপাঠী স্মরণ করে বলেন, রাজু সবসময় বলত—শিক্ষা যদি ভয়হীন না হয়, তবে সেটা দাসত্ব শেখায়, মুক্তি নয়।

রিকশাচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমি প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়েই যাই, কিন্তু এই ভাস্কর্যটার নাম যে রাজু, সেটা আজই জানলাম। মনে করতাম হয়তো কোনো সাধারণ ভাস্কর্য। এত বড় ইতিহাস আছে এর পেছনে, তা জানতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নামেও এমন কিছু হয়, এটা আমার কাছে অবাক লাগছে।

এক দোকান কর্মচারী বলেন, টিএসসির পাশে ভাস্কর্যটা প্রায়ই দেখি, কিন্তু রাজু কে ছিলেন, তা জানি না। শুধু জানি, এখানে অনেক অনুষ্ঠান আর আন্দোলন হয়। কেউ বলেন শহীদ রাজু, কিন্তু কী কারণে শহীদ হয়েছেন, সে খবর কখনো শুনিনি। এখন মনে হচ্ছে জানা উচিত ছিল।

এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেন, আমি রাজু ভাস্কর্য নামটা শুনেছি, কিন্তু এর ইতিহাস জানি না। বন্ধুরা মাঝে মাঝে টিএসসিতে আড্ডা দিতে যায়, সেখানেই নামটা শুনেছি। ভাস্কর্যটার পেছনে কোনো শহীদের গল্প আছে জানতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যারা পড়ি, তাদের কাছে এসব তথ্য খুব অজানা।

১৩ মার্চ ১৯৯২: রাজুর মৃত্যুর দিন

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ, শুক্রবার। দিনটি ছিল উত্তপ্ত—ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। রাজু মারামারির খবর শুনে মধুর ক্যান্টিনে যান। সেখানে তিনি দেখেন, ছাত্রদলের কর্মীরা ছাত্রশিবিরের এক কর্মীকে মারধর করছে। শিবির কর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে রাজু আহত হন, তার হাতে কেটে যায়। তিনি হাতে ব্যান্ডেজ করে শহীদুল্লাহ হলে নিজের কক্ষে যান এবং বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু বন্ধুরা অসুস্থ শরীর নিয়ে বাসায় না যাওয়ার পরামর্শ দেন।

1

বিকেলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজু তার তিন বন্ধু মাহমুদ, সাইফুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে বাইরে বের হন। রিকশায় ঘুরে তারা টিএসসিতে আসেন। টিএসসির ফটকে তখন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চলছিল। কিছুক্ষণ পর উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম ফটকে অবস্থান করছিল। টিয়ার গ্যাস ছোড়ে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে।

বৃষ্টি শুরু হলে গোলাগুলি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়। পরে আবার সংঘর্ষ শুরু হলে রাজু ও তার বন্ধুরা গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নামে একটি মিছিল বের করে স্লোগান দিতে থাকেন। মিছিলটি টিএসসির পূর্ব গেট থেকে শুরু হয়ে হাকিম চত্বর ঘুরে ফিরে আসে। তখন আবার গুলিবর্ষণ শুরু হয়।

রাজু গুলিবিদ্ধ হয়ে বন্ধুর কাঁধে পড়ে যান। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু তিনি বাঁচেননি।

বিচারের পথে রাজু: দীর্ঘ অপেক্ষার কাহিনি

রাজুর মৃত্যুর পর ছাত্র ইউনিয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কাগজে-কলমে ঝুলে যায়। কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষিত হয়নি, আর হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ে বিচার প্রক্রিয়া থেমে যায়।

১৯৯৭ সালে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করে তাকে স্মরণীয় করে রাখলেও, তার হত্যার বিচার আজও অধরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন প্রতিবছর ১৩ মার্চ রাজুর মৃত্যুবার্ষিকী সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে।

এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিদিন টিএসসিতে আসি, আড্ডা দিই, চা খাই। কিন্তু যতবার রাজু ভাস্কর্যের দিকে তাকাই, ততবার মনে হয় আমরা এক বিশাল ইতিহাসের পাশে বসে আছি। অনেকেই জানে না, এই জায়গায় যে রাজু নামে একজন তরুণ নিজের জীবন দিয়েছে, সেই ত্যাগেই আজ আমরা অবাধে মত প্রকাশ করতে পারি। ভাস্কর্যটা শুধু রাজুর স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটা প্রতিরোধের মঞ্চ।

চা বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর ধরে এখানে দোকান দিচ্ছি। প্রতিদিন শত শত মানুষ রাজু ভাস্কর্যের পাশে বসে, আড্ডা দেয়, ছবি তোলে। কিন্তু সবাই জানে না, এখানে রাজু নামে এক ছাত্র শহীদ হয়েছিল। মনে হয়, রাজুর আত্মা এখনো আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, সবাইকে সাহস দেয় প্রতিবাদের।

রাজু ভাস্কর্য: প্রতীকে রূপ নেয় এক মৃত্যু

১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে স্থাপিত হয় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য।

ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন শিল্পী শামসুল আলম চৌধুরী শ্যামল ও গোপাল পল। এতে দেখা যায়, একদল তরুণ-তরুণী হাতে হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে—যেন স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের চিরন্তন যাত্রা।

4

রাজুর নামেই নামকরণ করা হয় ভাস্কর্যটি, যা পরে জনপ্রিয়ভাবে পরিচিত হয় রাজু ভাস্কর্য নামে। এটি শুধু তার স্মৃতিচিহ্ন নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে গণতন্ত্র, ন্যায্যতা ও সাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আজও যখন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামে, প্রথমে তারা জড়ো হয় এই ভাস্কর্যের সামনে—যেন রাজুর আত্মা এখনো তাদের সঙ্গে হাঁটে।

এখনও বিচার হয়নি রাজু হত্যার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে প্রতিদিনের কোলাহল, সঙ্গীত ও স্লোগানের মাঝেও রাজু ভাস্কর্য এক নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এটি শুধু এক তরুণ ছাত্রের স্মৃতি নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সাহস ও প্রতিবাদের জীবন্ত প্রতীক।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যে রাজুর নামে ভাস্কর্য, সেই রাজুর হত্যার বিচার কবে হবে?

যে প্রজন্ম তার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে কথা বলে, তারা কি জানে—এই মাটিতে এক রাজুর রক্ত মিশে আছে?

রাজু ভাস্কর্যের পাশে বসে আজও কেউ গান গায়, কেউ ছবি তোলে, কেউ প্রেম নিবেদন করে—কিন্তু রাজুর আত্মা হয়তো নীরবে বলে যায়, আমি মরিনি, আমি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছি।

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিচার দাবি করে আসছি। রাজুর মৃত্যুর সময় তার বাবা দেশে ছিলেন, তিনি পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন রাজুর পোস্টমর্টেম করবেন না। এরপর থেকেই বিচার প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি হয়নি। তখন শাহবাগ থানা ছিল না, রমনা থানা ছিল। রমনা থানায় খুঁজলে সেই কাগজপত্র পাওয়া যেতে পারে। আমি তখনও বলেছি, এখনও বলব—সরকার যদি উদ্যোগী হয়, তবেই রাজুর হত্যার বিচার সম্ভব। সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী হয়ে রাজুর মৃত্যুর বিচার করা উচিত।

এম/এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর