শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিসিএস প্রস্তুতি: কারা সবচেয়ে বেশি সফল?

মাহফুজুর রহমান
প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

BCS
বিসিএসর প্রস্তুতি হিসেবে লাইব্রেরিতে গ্রুপ স্টাডি করছেন দুজন শিক্ষার্থী। ফাইল ছবি

বাংলাদেশে চাকরিপ্রত্যাশীদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন, বিসিএস ক্যাডার হওয়া। প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হন অল্প কয়েকজন। তারা কারা? কোন পটভূমি, বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি সফল? কীভাবেই বা তারা নিজেদের প্রস্তুত করছেন— এই প্রশ্নগুলো এখন তরুণ সমাজে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

প্রতিযোগিতার চিত্র: লাখে একজনের স্বপ্নপূরণ


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ২ লাখ ৬৮ হাজারেরও বেশি প্রার্থী। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ১২ হাজার ৭০০ জনের মতো, আর লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পাবেন দুই-আড়াই হাজারের মতো। অর্থাৎ প্রতি একশ জনে কেবল এক-দুজনের ভাগ্য খুলছে।

এই হিসাব থেকেই বোঝা যায়, বিসিএস কেবল একটি পরীক্ষা নয়— এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, মানসিক সহনশীলতা ও ধৈর্যের এক চরম পরীক্ষা।

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে?


বিজ্ঞাপন


প্রতিবারের মতোই দেশের বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিসিএসে প্রাধান্য ধরে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সফল। এরপরেই অবস্থান চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মূল পার্থক্য তৈরি হচ্ছে শিক্ষার মান, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির পরিকাঠামোয়। ঢাকার মতো শহরে শিক্ষার্থীরা কোচিং, গাইডলাইন, স্টাডি গ্রুপ ও অনলাইন সহায়তার সুযোগ বেশি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিভাগীয় বা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক সময় সেই সুযোগ সীমিত।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিসিএসে ভালো ফল করছেন। অনলাইন ক্লাস, টেলিগ্রাম ও ইউটিউবের মাধ্যমে তারাও এখন প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই।

বিষয়ভিত্তিক সফলতা: মানবিক বিভাগের দাপট

বিসিএসের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, কর বা কাস্টমস ক্যাডারে মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি সফল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইংরেজি, আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিসিএসের মূল বিষয়গুলো যেমন বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজি—এসব বিষয়ে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বচ্ছন্দ। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা লিখিত অংশে কিছুটা পিছিয়ে পড়েন। যদিও তারা টেকনিক্যাল ও স্বাস্থ্য ক্যাডারে ভালো ফল করেন।

বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখন বিভিন্ন নতুন দিক যেমন— আইসিটি, পরিসংখ্যান, ডেটা বিশ্লেষণভিত্তিক পদে নিজেদের ভূমিকা বাড়াচ্ছেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারেও চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবেই বড় অংশ দখল করে আছেন।

প্রস্তুতির ধরণ: বই, নোট আর ডিজিটাল মাধ্যমের যুগলযাত্রা

একসময় বিসিএস মানে ছিল ‘ঢাকায় কোচিং করা, বই কিনে পড়া, নোট মুখস্থ করা’। এখন চিত্রটা অনেক বদলে গেছে।

সফল প্রার্থীদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, তারা এখন প্রস্তুতিতে অফলাইন কোচিংয়ের পাশাপাশি অনলাইন ক্লাস, ইউটিউব লেকচার, টেলিগ্রাম গ্রুপ, এমনকি রেডিমেড নোটবুক ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ সম্পূর্ণ স্বশিক্ষণ পদ্ধতিতেই সফল হয়েছেন।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কারণে এখন রাজশাহী বা বরিশালের শিক্ষার্থীও ঢাকার প্রস্তুতির মানে পৌঁছে যেতে পারছেন।

একজন প্রশাসন ক্যাডারে নির্বাচিত প্রার্থী বলেছিলেন, ‘আমি ইউটিউবের ক্লাস, পিডিএফ নোট আর টেলিগ্রাম গ্রুপ দিয়েই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কখনো কোচিংয়ে যাইনি, তবুও সফল হয়েছি।’

অর্থাৎ প্রস্তুতির ধরনে এখন বহুমাত্রিকতা এসেছে, যা আগের প্রজন্মের তুলনায় নতুন একটি ধারা তৈরি করছে।

bcs--2
বিসিএস পরীক্ষার একটি কেন্দ্রের দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত

সময় ও অধ্যবসায়: গড় প্রস্তুতি দেড় থেকে দুই বছর

প্রার্থীদের মধ্যে সাধারণ প্রবণতা হলো, বিসিএস প্রস্তুতিতে গড়ে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। কেউ কেউ একাধিকবার চেষ্টা করে সফল হন। অনেকে প্রথম বা দ্বিতীয় প্রচেষ্টাতেই উত্তীর্ণ হন, কিন্তু তা ব্যতিক্রম।

৪৩তম বিসিএসের একজন প্রশাসন ক্যাডার বলেন, ‘প্রথম দুইবার ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু সেই ব্যর্থতাই আমাকে নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে শিখিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তমবারে সফল হয়েছি।’

এই গল্পগুলোই বলে দেয়— বিসিএসে সফলতা কেবল মেধার নয়, বরং অধ্যবসায় ও মানসিক দৃঢ়তার প্রতিফলন।

নারী প্রার্থীদের সাফল্য: নতুন প্রজন্মের উত্থান

বিগত কয়েকটি বিসিএসে নারীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্যের হার দুটোই বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সফল প্রার্থী নারী। পররাষ্ট্র, প্রশাসন, শিক্ষা ও কাস্টমস ক্যাডারে নারীরা দারুণ সাফল্য দেখাচ্ছেন। অনেকেই বিবাহ ও পরিবারের দায়িত্ব সামলেও নিয়মিত প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাডার হয়েছেন।

৪৪তম বিসিএসের এক পুলিশ ক্যাডার বলেন, ‘গ্রামে পড়াশোনা করেছি, প্রথমে আত্মবিশ্বাস ছিল না। কিন্তু অনলাইন নোট আর কোচিং ভিডিও আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। মেয়েরা চাইলেই পারে, শুধু মনোযোগ আর ধারাবাহিকতা দরকার।’

এই ধরনের উদাহরণই প্রমাণ করে, বিসিএসে এখন নারীরা শুধু অংশগ্রহণ করছেন না, নেতৃত্বও দিচ্ছেন।

শহর বনাম গ্রাম: সমান সুযোগ এখনো নয়

যদিও ডিজিটাল যুগে শহর-গ্রামের ফারাক অনেকটাই কমেছে, তবুও বাস্তবতায় কিছু ব্যবধান রয়ে গেছে। শহরের শিক্ষার্থীরা কোচিং, লাইব্রেরি, গাইডলাইন ও ইন্টারনেট সুবিধা সহজে পান। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বিদ্যুৎ বা নেটওয়ার্ক সমস্যা, বইয়ের অপ্রাপ্যতা ও সময় সংকটে পড়েন।

তবে পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘বিসিএস প্রস্তুতি বাংলাদেশ’ বা ‘বিসিএস টেলিগ্রাম কমিউনিটি’র মতো গ্রুপগুলো গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সহায়তা হয়ে উঠেছে।

একজন সফল প্রার্থী জানিয়েছেন, ‘আমি কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অনলাইন নোটে পড়েছি। ইন্টারনেট থাকলেই সুযোগ তৈরি হয়, এখন শহরে গিয়ে কোচিংয়ের দরকার পড়ে না।’

কোচিং ও অর্থনীতি: এক বিশাল শিল্পখাত

বিসিএস এখন কেবল একটি পরীক্ষা নয়, এটি এক বিশাল কোচিং শিল্পে পরিণত হয়েছে। আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বিসিএস প্রস্তুতিতে কোচিং, বই ও অনলাইন সাবস্ক্রিপশনে খরচ হয় কয়েকশ কোটি টাকা।

ঢাকার মিরপুর, আগারগাঁও বা শাহবাগ এলাকায় বিসিএস কোচিং সেন্টারগুলো এখন এক ধরনের ব্যবসায়িক ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে। একদিকে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়, অন্যদিকে পরীক্ষার চাপ—সব মিলিয়ে এক বিশাল ‘বিসিএস ইকোনমি’ গড়ে উঠেছে।

তবে অনেকে মনে করেন, কোচিং প্রয়োজনীয় হলেও নির্ভরশীলতা বেশি হলে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ শেষ পর্যন্ত মূল প্রস্তুতি নির্ভর করে প্রার্থীর আত্মপ্রচেষ্টার ওপরই।

চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে

বিসিএস প্রক্রিয়া এখনো ধীরগতির অভিযোগে ঘেরা। একটি পরীক্ষার প্রিলিমিনারি থেকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হতে প্রায় দুই বছর লেগে যায়। এতে প্রার্থীদের মানসিক ও আর্থিক চাপ বাড়ে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো বয়সসীমা। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী চাকরি না পেয়ে বয়সসীমা পেরিয়ে যান।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার মানের বৈষম্যও বিসিএস ফলাফলে প্রভাব ফেলছে। ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যেখানে উচ্চমানের রিসোর্স পান, সেখানে ছোট কলেজের শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়েন।

বিসিএস কি সবার জন্য সমান সুযোগের পরীক্ষা?

একদিকে ঢাকা বা বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষার্থীরা উন্নত রিসোর্স ও নেটওয়ার্কের সুবিধা পান, অন্যদিকে গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সীমিত সুযোগে লড়াই করেন। তবুও নিয়মিততা, আত্মনিবেদন ও মনোবল দিয়ে তারা সফল হচ্ছেন, এটাই বিসিএসের সৌন্দর্য।

বিসিএস আজও দেশের তরুণদের কাছে সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও জাতি গঠনের প্রতীক। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে প্রশাসন, কূটনীতি ও আইনশৃঙ্খলার পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব।

বিসিএসে সফলতা কোনো এক দিনের ব্যাপার নয়, এটি বছরের পর বছর অধ্যবসায়, পরিকল্পনা ও আত্মবিশ্বাসের ফল। সফলদের প্রোফাইল বলছে, তারা শুধু পড়াশোনায় নয়, মানসিক দৃঢ়তায়ও আলাদা। তারা জানেন, ব্যর্থতা আসবে, কিন্তু সেটাই শেষ নয়।

আজ যারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের জন্য সফলদের বার্তা একটাই, নিয়মিততা, মনোযোগ আর আত্মবিশ্বাস—এই তিনই বিসিএসের চাবিকাঠি।

এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর