রাজধানীর পল্লবী থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য মিলে রীতিমতো চাঁদার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই চক্রে জড়িত সদস্যরা অটোরিকশার গ্যারেজ থেকে শুরু করে মাদক কারবারি, ডেভেলপার কোম্পানি এবং রাতের বেলা তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে থানায় নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন।
পুলিশের এই চক্রটির বিরুদ্ধে মুখ খুলে ভয়ে অনেকেই এখন এলাকাছাড়া। কেউ কেউ নীরবে দিয়ে যাচ্ছেন চাঁদা। এ চক্রের সদস্যদের তালিকায় উঠে এসেছে একাধিক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নাম। যারা রাত হলেই তাদের সোর্সসহ সিভিল পোশাকে হানা দেন বিভিন্ন অটোরিকশার গ্যারেজ ও মাদকের স্পটে। বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে তল্লাশির নামে খুঁজে বেড়ান শিকার। জিম্মি করে টাকা আদায়ই তাদের প্রধান কাজ।
বিজ্ঞাপন
টাকা চাওয়ার অডিও রেকর্ড ভাইরাল
পল্লবী থানা পুলিশের চাঁদা চাওয়ার একটি অডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ঢাকা মেইলের হাতে আসা অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী একটি ডেভেলপার কোম্পানির প্রতিনিধিকে বলছেন, আজকে একটা এমাউন্ট দিতে হবে। আজকে তিন টাকা (৩ লাখ) আর প্রতি মাসে দুই টাকা (২ লাখ) দিয়ে দেবেন। এটা আগামী মাস থেকে দেবেন। আমি ওসি স্যার ও তদন্ত স্যারকে ময়ানেজ করব। উপরে স্যারেরা ম্যানেজ করে নেবে। আমরা লোকাললি কাজ করি তো, এদিকের একটা বিষয় আছে। আপনাদের কোনো সমস্যা হলে আমাদের কল করলেই আমরা চলে আসব। অপজিট পার্টি অভিযোগ নিয়ে আসলে কোনো কাজ হবে না আর। আমরা সাইলেন্ট থাকব।’
৮ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তা এবং ওসি তদন্ত-এর কথা বলে একটি ডেভেলপার কোম্পানির প্রতিনিধির কাছে এককালীন তিন লাখ ও মাসিক দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করছেন মোহাম্মদ আলী।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানে জানা যায়, পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী, এসআই তোফাজ্জল এবং তাদের সোর্স মনির হোসেন এই চক্রের মূল সদস্য। তারা পুলিশের পোশাক ছাড়াই গভীর রাতে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মাদকের স্পট থেকে শুরু করে রিকশার গ্যারেজ সব জায়গায় হাজির হন। পল্লবী থানা এলাকার ১০টিরও বেশি মাদক স্পট থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন এসআই মোহাম্মদ আলী। এর মধ্যে মিল্লাত ক্যাম্প মাদক স্পট থেকে বাবুর্চি শাওন এবং কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের শাহজাদী, আসলাম ও শারমিনের মাদক স্পট থেকে এক ভুয়া সাংবাদিকের মাধ্যমে তিনি টাকা কালেকশন করেন।
জিম্মি করে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়
১২ সেপ্টেম্বর রাত ২টা। পল্লবী থানাধীন বাউনিয়াবাঁধ মুচিপট্টির একটি অটোরিকশার গ্যারেজে হানা দেয় পুলিশ। চোরাই রিকশা আছে এমন অভিযোগ এনে গ্যারেজ মালিক সোবহানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। অভিযানে ছিলেন পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী ও তোফাজ্জাল এবং তাদের সোর্স মনির। এ সময় মোহাম্মদ আলী ও তোফাজ্জল সিভিল পোশাকে ছিলেন। সোবহানকে আটকের সময় মোহাম্মদ আলী তার শ্বশুর সুমন মিয়াকে বলছিলেন- ‘তাকে ছাড়াইতে হলে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে। ৫ লাখ টাকা না দিলে গ্যারেজের সব রিকশা থানায় নিয়ে যাবো। আপনারা দ্রুত থানায় এসে যোগাযোগ করেন।’
আরও পড়ুন
দুই আনসার সদস্যের ‘গোপন সাম্রাজ্য’, এক ভবনেই ৫ ফ্ল্যাট!
মাদক পাচারে বাংলাদেশ এখন ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’
পরে রাত ৪টার দিকে পল্লবী থানার পাশে ঢালের গলিতে চা দোকানে মোহাম্মদ আলীর হাতে ৭৫ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়। এরপর সকালে সোবহানকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান শ্বশুর সুমন মিয়া।
সোবহান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হঠাৎ করে রাত ২টার সময় আমার রিকশার গ্যারেজে সিভিল পোশাকে পল্লবী থানার এসআই মোহাম্মদ আলী ও তোফাজ্জল এবং তাদের সোর্স মনির আসেন। এসেই আমার গ্যারেজে চোরাই রিকশা আছে বলে আমাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে থানায় নিয়ে যান। সেখানে আমাকে ডিউটি অফিসারের রুমে বসিয়ে রাখেন। এরপর আমার শ্বশুরের কাছে তারা খবর পাঠায় ৫ লাখ দিলে আমাকে ছেড়ে দেবে, না হয় আমার গ্যারেজের সব রিকশা থানায় নিয়ে আমার বিরুদ্ধে চুরির মামলা দেবে। বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমার শ্বশুর বিভিন্ন দিক থেকে ৭৫ হাজার টাকা ধার করে এনে থানার পাশে ঢালের গলিতে একটি চা দোকানে এসআই মোহাম্মদ আলীর হাতে দেন। পরে আমাকে সকাল ছেড়ে দেয়।’
চক্রটির বিরুদ্ধে একই ধরনের হয়রানির অভিযোগ করেছেন আরেক ভুক্তভোগী শওকত আলী। তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে রাস্তায় আটক করে চক্রটি। এরপর তার কাছে থেকে ৫০ হাজার টাকা চাইলে তিনি ৫ হাজার টাকা দেন। সেই টাকা নিয়েও তাকে আদালতে পাঠিয়ে দেয়।
শওকত আলী বলেন, ‘৩ অক্টোবর রাতে মিরপুর ১১ নম্বর মিল্লাত ক্যাম্প পানির পাম্পের পাশে আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে থানায় নিয়ে যান এসআই মোহাম্মদ আলী। এ সময় তার সাথে অনেক লোক ছিল, তাদের চিনতে পারিনি। ওই সময় এসআই মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাকে ছাড়াতে হলে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। আমি সেই টাকা দিতে পারবো না বলে জানালে ৩০ হাজার টাকা দিতে বলে। তাও দিতে পারবো না বললে ২০, এরপর ১৫, এরপর ১০ হাজার টাকা দিতে বলে। তাও দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই বললে, তখন ৫ হাজার টাকা ম্যানেজ করে দিতে বলে। আমি আমার বন্ধু থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে দেওয়ার পর আমাকে পাচানি (ডিএমপি অধ্যাদেশে) আদালতে পাঠায়।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলী ও তোফাজ্জলকে কয়েক দফায় তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হয়। সাড়া না পেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তারা কোনো উত্তর দেননি। এজন্য তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলেন। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে এলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এমন ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলে রায়ে তাদের পদাবনতিসহ চাকরি চলে যেতে পারে। ভুক্তভোগীরা আমাদের কছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
একেএস/জেবি

