চাকরির শুরুটা সিপাহি পদে, বেতন মাত্র ৯ হাজার টাকা। এরপর ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে আনসার কমান্ডার (পিসি) হয়েছেন শহীদুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলাম। অথচ এই দুজন এখন কোটি টাকার মালিক। একটি ভবনে একসঙ্গে কিনেছেন পাঁচটি ফ্ল্যাট, যার মধ্যে একটি একজনের স্ত্রীর ভাইয়ের নামে। এর বাইরেও তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
আনসার কমান্ডার পদে দায়িত্ব পালনের সুবাদে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—পিজি হাসপাতাল ও পাসপোর্ট অফিসে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তারা। অভিযোগ উঠেছে, এ সময় দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে গড়ে তুলেছেন অঢেল অবৈধ সম্পদ। স্থানীয়দের মধ্যে বিষয়টি বেশ আলোচিত।
বিজ্ঞাপন
দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাতে সম্পদের পাহাড়
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শহীদুল ইসলাম ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজধানীর পিজি (সাবেক বঙ্গবন্ধু) হাসপাতালে আনসার কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি প্রভাব খাটিয়ে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া বেসরকারি হাসপাতালের দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে আফতাবনগর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে বদলি হন। সেখানেও দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাত করেন। এভাবে দুই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি।
অন্যদিকে, জহিরুল ইসলাম বর্তমানে শরীয়তপুরের সখিপুর উপজেলার আনসার ক্যাম্পে কর্মরত। এর আগে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে একইভাবে অবৈধভাবে সম্পদ গড়ে তোলেন।
বিজ্ঞাপন
এক ভবনে ৫ ফ্ল্যাট, শেয়ারে জমি!
২০২১ সালে ঢাকার হাজারীবাগের বারৈখালী এলাকার ২ নম্বর রোডে ১৮ জন মিলে ৪২ কাঠার একটি প্লট জনপ্রতি ২০ লাখ টাকার শেয়ারে কেনেন। ওই জমিতে ‘রিভারভিউ বন্ধন’ নামে একটি বহুতল আলিশান ভবন নির্মাণ করা হয়।
আরও পড়ুন
পুলিশের জালে হানি ট্র্যাপের হোতারা!
জহিরুল ইসলাম ভবনটির অষ্টম তলায় ১২৫০ বর্গফুটের দুটি এবং ৬৯০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেন। এছাড়াও, নিজের সম্পদ গোপন করতে ৬ষ্ঠ তলায় ৬৯০ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট স্ত্রীর ভাইয়ের (শ্যালক) নামে কিনেছেন। সব মিলিয়ে তার ফ্ল্যাটগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।
শহীদুল ইসলাম একই ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ১৬৩০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার বর্তমান মূল্য আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। এছাড়াও, তিনি গাবতলী এলাকায় আরও একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটেই তাদের কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
কাগজপত্রেই মালিকানার প্রমাণ
‘রিভারভিউ বন্ধন’ প্রকল্পের মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে। সেখানে কার কোন ফ্ল্যাট, কোন ফ্লোরে—সবই উল্লেখ রয়েছে।
২০২৫ সালের ১০ মে তারিখে ফ্ল্যাট হস্তান্তরকারী কমিটির আহ্বায়কসহ চার সদস্য স্বাক্ষরিত কাগজে দেখা যায়, শহীদুল ইসলাম ভবনের পঞ্চম ফ্লোরে (যেটি প্রকৃতপক্ষে ৬ষ্ঠ তলা), ফ্ল্যাট ‘এ’ এর মালিক। একইভাবে, জহিরুল ইসলাম ভবনের সপ্তম ফ্লোরে (৮ম তলা), ফ্ল্যাট ‘বি’ এর মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবনের এক প্রকৌশলী জানান, ২০২১ সালে ওই ৪২ কাঠার প্লটটি শেয়ারে কেনা হয় এবং এ বছরের শুরুতে ১১ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
তিনি জানান, শহীদুল ইসলামের ১৬৩০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ৬ষ্ঠ তলায়। এছাড়া আরও কয়েকজন আনসার সদস্যের মালিকানায় ফ্ল্যাট রয়েছে ভবনটিতে।
জমির মালিক আবুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে সাড়ে সাত লাখ টাকা করে কিছু আনসার সদস্য আমাদের কাছ থেকে জমির শেয়ার কিনে নেয়। পরে ধীরে ধীরে জায়গা ডেভেলপ করে ফ্ল্যাট তৈরি করেছে। ফ্ল্যাট তৈরি করতে যথেষ্ট খরচ হয়েছে। কারা আনসার, কারা সরকারি কর্মকর্তা, সেটা আমাদের জানা নেই।’
বিপুল সম্পদের কথা অকপটে স্বীকার
ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে আনসার কমান্ডার (পিসি) শহীদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা প্রায় ৬-৭ বছর আগে ১৮ জন মিলে শেয়ারে একটি জায়গা নিয়েছি। সেখানে এখন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। আমি একটি ফ্ল্যাট পেয়েছি। আমি সিপাহী থেকে আনসার কমান্ডার হয়েছি। পিজি হাসপাতাল, আফতাবনগর পাসপোর্ট অফিসসহ কয়েকটি স্থানে দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে আমি অবসরপ্রাপ্ত।'
আরেক আনসার সদস্য জহিরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমি অনেক কষ্টে একটা শেয়ার কিনেছি। আমার আত্মীয়রা দেশের বাইরে থাকায় আমাকে টাকা ধার দিয়েছিল। সেই টাকায় আমি ফ্ল্যাট কিনেছি। এছাড়াও, আমার শালাকে একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি।'
এত সম্পদ এলো কোথা থেকে?
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সরকারি চাকরির সীমিত আয়ের মধ্যে এত ফ্ল্যাট কেনা কীভাবে সম্ভব? দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে উপার্জিত অর্থে এ সম্পদ গড়া হয়েছে কি না—তা তদন্তের দাবি জানান তারা।
তারা বলছেন, সরকারি ইউনিফর্ম পরে, দেশের সেবার নামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন আনসার সদস্যরা, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস আলী বলেন, ‘একজন আনসার সদস্য হয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়তে পারেন না যদি তিনি অবৈধ পন্থায় উপার্জন না করতেন। আনসাররা এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে টাকা আদায় করেন না। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্ব পালনের সময় দালাল চক্রের সাথে মিশে মোটা অঙ্কের টাকা ইনকাম করেন। এদের বিরুদ্ধে এখনই সরকার কোনো ব্যবস্থা না নিলে সবাই এমন দুর্নীতি করবে।’
আরেক বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, ‘সরকারি চাকরির সীমিত আয়ের মধ্যে এত ফ্ল্যাট কেনা কীভাবে সম্ভব? দালাল চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে উপার্জিত অর্থে এই সম্পদ গড়া হয়েছে কি না—তা তদন্তের দাবি রাখে। একজন সরকারি পোশাক পরে দেশের দায়িত্ব পালনের নামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। এদের বিরুদ্ধে সরকার দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে- সেটাই প্রত্যাশা করি।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারি যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশাল সম্পদের মালিক হওয়াটা অস্বাভাবিক। যদি এর সাথে সম্পদের অস্বাভাবিক সামঞ্জস্যতা থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতা অপব্যবহার করে এ সম্পদের মালিক হয়েছেন। চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আনসার সদস্যদের এমন অস্বাভাবিক সম্পদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বাহিনীকে বিভাগীয় তদন্তসহ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি, দুর্নীতি দমন কমিশনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
একেএস/জেবি

