গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের নানা অপকর্মের হোতা হিসেবে পরিচিতি সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ কে এম নাহিদুল ইসলামকে অবশেষে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ২টায় অভিযান চালিয়ে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। গত বছরের জুলাই আন্দোলন ঠেকাতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা অতি উৎসাহী ও মারমুখি ছিলেন তাদের একজন নাহিদুল ইসলাম।
আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের পর তার নানা অপকর্মের ফিরিস্তি সামনে আসতে শুরু করেছে। তিনি বিরোধী দল ও মত দমনে ছিলেন বেপরোয়া। ভিন্নমতের লোকদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যার একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সবশেষ জুলাই আন্দোলন ঠেকাতে তাকে সরাসরি গুলি করতে দেখা গেছে। এছাড়াও অগণিত অভিযোগ রয়েছে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারকে নানা অপকর্মের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জোরালো ভূমিকা রাখেন তাদের একজন নাহিদুল ইসলাম। এজন্য গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের আশীর্বাদপুষ্টও ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
নাহিদুল ইসলামের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শুরুটা মেহেরপুরের পুলিশ সুপার থাকাকালে। ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর মেহেরপুর সদর উপজেলার হিজুলি গ্রামের বাসিন্দা জামায়াত নেতা ও ইউপি মেম্বার আব্দুল জব্বারকে আটক করে থানা পুলিশ। ওই রাতেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তিনি। এ ঘটনা দেশজুড়ে বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।
পুলিশ সেই জামায়াত নেতাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে সেটা তখনও সবাই জানতে পারেন। তবে তখন কোনো মামলা করার সুযোগও ছিল না। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে এ কে এম নাহিদুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন নিহতের ছেলে আব্দুল মালিতা। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর আদালতে দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় আরও ২৫ জনকে।
এজাহারনামীয় ২৬ জন আসামির মধ্যে রয়েছেন-তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদ মোমিন মজুমদার, সদর থানার এসআই শরজিদ কুমার ঘোষ, ওসি তদন্ত তরিকুল ইসলাম, এসআই গাজী ইকবাল হোসেন, কনস্টেবল সাধন কুমার ও নারদ কুমার, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম। এ ছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, নিহত আব্দুল জব্বার ইসলামি ভাবাদর্শের তৃণমূল নেতা এবং আমঝুপি ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আমঝুপি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। এ সময় আব্দুল জব্বারের পাশাপাশি তার ছেলে আব্দুল মালিতাকে গ্রেফতার করে সদর থানাহাজতে রাখে পুলিশ। পরে ছেলেকে একটি মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হলেও আব্দুল জব্বারকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন শেষে বুকে পিঠে একাধিক গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার দুই মাস পর বাদী জামিনে মুক্তি পেয়ে সাক্ষীদের কাছ থেকে তার বাবাকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারেন।
মেহেরপুরের সাবেক এসপি নাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যার ঘটনা তখন আলোচিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন এসপি নাহিদুল ইসলামের নির্দেশে মেহেরপুর শহরের ইসলামী ব্যাংকের প্রধান ফটকের সামনে থেকে তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যান। অজ্ঞাত স্থানে তাকে আটকে রেখে পরিবারের কাছে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন পুলিশ সুপার নাহিদুল ইসলাম ও সদর থানা পুলিশ। পরে ওইদিন রাত ১১টার দিকে বামনপাড়া শ্মশানঘাটে তারিকের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে বুক ও পেটে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায়ও জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে এ কে এম নাহিদুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে ১৯ জনের নামে মামলা করা হয়। সেই মামলায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ভূমি কমিশনারকে (এসিল্যান্ড) আসামি করা হয়।
ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা ছাড়াও ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যায়, কালো ও খয়েরি রঙ যুক্ত একটি ফুলহাতা জ্যাকেট ও ছাই (এস) রঙের প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় চায়না রাইফেল হাতে গুলি করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় তার সাথে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য অস্ত্র হাতে সামনের দিকে এগিয়ে যান।
গত ২৮ জুলাই কর্মস্থলে অনুপস্থিতসহ নানা অপরাধের দায়ে এক প্রজ্ঞাপনে এ কে এম নাহিদুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন
পুলিশের ‘তছনছ’ হওয়ার বছর
আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হত্যা, গুমের পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন সরকার এ কে এম নাহিদুল ইসলামকে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই পদোন্নতি দিয়ে ডিআইজি পদে পদায়ন করে। পদোন্নতির পর তাকে সিআইডিতে রাখা হয়। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর নাহিদুল ইসলামকে সিআইডি থেকে সরিয়ে পুলিশ টেলিকমে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে তিনি এক সময় খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) ছিলেন। নাহিদুল ইসলাম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা।
একেএস/জেবি

