শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘পুলিশের মোরাল একদম পড়ে গিয়েছিল, এখন শতভাগ ঠিক’

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১১:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

dmp-sajjat
শেখ মো. সাজ্জাত আলী। ছবি: ঢাকা মেইল

ঢাকা মেট্রোপলিট পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী বলেছেন, বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর পুলিশের মোরালিটি একদম পড়ে গিয়েছিল। তাদের অর্ডার করার পরও শুনতে চাইতো না। নৈতিকভাবে তারা পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ সময় লেগেছে সেটা ঠিক করতে। এখন পুলিশ স্বাভাবিক কাজে ফিরেছে। তাদের মোরালিটি শতভাগ ঠিক হয়েছে।

তিনি বলেছেন, সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির অনেক কারণ থাকে। বেকারত্ব, হতাশা এর মধ্যে অন্যতম। যুব সমাজকে কাজ দিতে হবে। হতাশা দূর করতে হবে। শুধু পুলিশকে দিয়ে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। পুলিশের কাজেও সহযোগিতা করতে হবে। তবেই অপরাধ কমে আসবে। গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ঢাকা মেইলকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রাজ্ঞ এই পুলিশ কর্মকর্তা এসব কথা বলেন।


বিজ্ঞাপন


শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী । ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন মাসের মাথায় ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর নিয়োগ পান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবে।  ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের সময়ে চাকরি হারান। চলতি বছর ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পান তিনি। কর্মজীবনে ডিএমপিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি আইন বিষয়ে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন সাজ্জাত আলী। চাকরি জীবনে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি)  সম্পন্ন করেন তিনি। পেশাগত কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পুরস্কার। দেশের একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া, পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ডিএমপির প্রস্তুতিসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বোরহান উদ্দিন। ছবি তুলেছেন শামিম হোসেন

ঢাকা মেইল: ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়ার পর আপনার কাছে চ্যালেঞ্জ কী ছিল এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করেছেন?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর থানা ধ্বংসযজ্ঞ, অস্ত্র লুট ও পুলিশের ক্যাজুয়ালিটির কারণে এই ফোর্সের মোরাল একদম পড়ে গিয়েছিল। অনেক পুলিশ অফিসার পলাতক ছিল এবং পুলিশকে দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হচ্ছিল না প্রথম চার-পাঁচ মাস। তারপরে পুলিশের ওয়েলফেয়ার দেখে এবং নানা ধরনের কাজ করে আস্তে আস্তে তাদের ভালোভাবে কাজে ফেরানো যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমনও হয়েছে যে, ২০ জন অডিটর এজি অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তা ব্লক করেছিল। আমরা যখন বললাম- ডিসপাস করো, তারা বললো করবে না।  স্যার, যা বলে বলুক। আমরা হুকুম মানবো না।  এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। এখন পুলিশের মোরাল ঠিক আছে।

সেইসঙ্গে প্রতিদিন রাস্তা ব্লকেড আর মানুষের দুর্ভোগ ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। বিডিআর আর আনসারের সদস্যরা রাস্তায় নেমেছিল এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন লোকজন নেমেছিল। ছয়-সাত মাস গিয়েছে রাস্তা মোকাবিলা করতে। বিনা পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে হবে, এই দাবি নিয়ে সচিবালয় ঘেরাও করেছিল। এখন কিছুদিন হলো আন্দোলন কমেছে। এটা করতে গিয়ে মোরাল ওঠাতে ওঠাতে অনেক দিন চলে গেল। এখন কিছুটা আন্দোলন কম, নির্বাচন হবে এজন্য অথবা আন্দোলনকারীরা ক্লান্ত। রাস্তা ঠেকানোর কারণে অন্যদিকে চিন্তা করতে পারিনি। ছিনতাই দমন বা অন্য কিছুর দিকে আমরা নজর দিতে পারিনি। ফোর্স অফিসার সবার নজর ছিল রাস্তার দিকে। এই সরকার আসার পর চার-পাঁচ মাস চাপাতি নিয়ে ছিনতাই হয়েছিল এবং ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


DMP2
ঢাকা মেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ডিএমপি কমিশনার। ছবি: ঢাকা মেইল

এই নগরীতে আড়াই -তিন কোটি লোকের বসবাস। দরিদ্রতা আর সামাজিক সমস্যাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নাগরিক জীবন। সেইসঙ্গে ভাসমান লোক আর ভাসমান ক্রিমিনাল রয়েছে। এখন যা হচ্ছে, আমি মনে করি সেটা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। ঈদের আগে ছিনতাই একদমই ছিল না। তারপর আওয়ামী লীগের মতো বড় দল নিষিদ্ধ হয়েছে এবং ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। ওরা মাঝে মাঝে বের হয়েছে এবং বিশেষ করে ফাঁকা জায়গাগুলোতে মিছিল করতো। আগারগাঁও এবং ধানমন্ডি, মিনাবাজারের সামনে, ৩০০ ফিটে মাইক্রোতে করে এসে ৮-১০ জন নেমে মিছিল করতো এবং এক মিনিট ভিডিও করতো। এরপর সেটা ফেসবুকে দিতো। সেটাও এখন নেই, বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকা মেইল: আপনারা রাস্তায় এত আন্দোলন করার সুযোগ দিলেন কেন?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আওয়ামী লীগ আমলে তারা মানুষকে পিটিয়ে আন্দোলন বন্ধ করত। আমরা তো এমন কাজ করব না। আমাদের পলিসি চেঞ্জড। রাস্তায় এদেশের মানুষকে বেধড়ক পেটাবো না, সে যেই হোক। একেবারে যদি সম্পদ ধ্বংস না করে ফেলে এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা আক্রমণ করে না বসে, তাহলে আমরা কোনো অ্যাকশনে যাবো না। বড়জোর এক বা দুইটা ঘটনায় টিয়ারগ্যাস আর কামান জল মারা হয়েছে। লাঠিচার্জ আমি আর করতে চাই না। একটাতে করা হয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা যখন কাকরাইল দিয়ে যমুনা ঢোকার চেষ্টা করছিল, তখন প্রথমে পানি মারা হয়েছে, পরে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। আরেকটা ঘটনায় হতে পারে। আমরা আর লাঠিচার্জ করতে চাই না। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক, আমরা এখন নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছি।

আরও পড়ুন

‘ওনারা খুব ভালো, তবে এনজিও আর রাষ্ট্র চালানো এক নয়’

‘যারা ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়েছেন তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে’

আমরা সব রাজনৈতিক দলের ঢাকার ইউনিটের প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ঢাকার রাস্তায় মিছিল আর ব্লক করলে ঢাকাবাসীর অনেক কষ্ট হয়। গর্ভবতী মহিলা আর রোগীদের হাসপাতালে যেতে সীমাহীন কষ্ট হয়। অ্যাম্বুলেন্স চলতে পারে না এবং স্কুল শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ রাস্তায় আটকে যাচ্ছে। আমি জায়গা নির্বাচন করেছি, কোথায় কোথায় মিটিং করলে ভোগান্তি কিছুটা কম হবে, সেটা আমি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বলবো আপনারা এসব জায়গায় মিটিং করেন। রাস্তায় মিছিল-মিটিং করা থেকে বিরত থাকেন, এটা পুলিশের কোনো স্বার্থ না স্বার্থ ঢাকাবাসীর।

ঢাকা মেইল: আপনি পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিটের প্রধান এবং বিশাল ফোর্স। এই শহরের মূল সমস্যা কোথায়?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ যখন ফেল করে, তখন সরকারের ওপর বর্তায় এবং সরকার পরিবর্তন হয়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে... কথাটা বললাম। শহরে কত বেকার আর কিশোর গ্যাং। এই ছেলেগুলো যাবে কোথায়, আপনি কী কাজ দিয়েছেন? ওরা ছিনতাই করবে না বা মারামারি করবে না, কী করবে। তাদের কাজ দেন এবং তাদের তো খরচ আছে। ধরেন, আপনার সারাদিন কোনো আয় নেই, কিন্তু আপনার সারাদিন ব্যয় আছে কি না? ব্যয় আছে। সকালে নাস্তা খেয়েছেন, আয় তো নাই। যেই লোকের কোনো ইনকাম নেই, তার খরচ ঠিকই আছে। কাজ ছাড়া কিশোর গ্যাং যাবে কোথায়? তারা কী করবে।  তাদের তো কাজ দিতে হবে।

ঢাকা মেইল: কিশোর গ্যাংদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বড় একটা অভিযোগ আছে এবং তারা আসলে কিশোর গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: ১৮-২৫ বছর বয়সীদের কাউকে লাগে না এবং তারা মনে করে নিজেরাই একশ। কারো কথা শোনেন না। পৃষ্ঠপোষকতা কিছু নয়, কথা হলো তাদের রক্ত গরম।

ঢাকা মেইল: ২০২৪ সালের আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকাটা আমরা খুবই নিষ্ঠুর দেখেছি...।

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারেননি অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেননি। কারণ তারা জানেন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা পদে থাকতে পারবেন না এবং তা-ই হয়েছে। তারা মানুষ মারার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জনগণের মুখোমুখি পুলিশকে দাঁড় করিয়েছেন। একটা সরকার পরিবর্তনের জন্য এত ক্যাজুয়ালিটি হবে কেন? স্বাধীন দেশে এত লোক মারতে হবে কেন, এরশাদ সাহেবের সময়ও তো এত লোক মরেনি। ১৯৯১ সালে আমি তখন ডিএমপির এসি। মৌচাকে দুই না তিনজন মারা গেল মালিবাগ রেলগেইটে। এরশাদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন পদত্যাগ করার। তিনি তো এত লোক মারেননি। এত লোক মারতে হবে কেন?

DMP3
রাজধানীকে নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনার কথা জানান ডিএমপি কমিশনার। ছবি: ঢাকা মেইল

পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে তৎকালীন আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি লোক হিসেবে খুব ভালো। আমার জুনিয়র এবং আমার অধীনস্থ এসি ছিলেন। খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু দুর্বল চিত্তের এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আমি হলে ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী যখন মিটিং করল, তারা জনগণের ওপর গুলি চালাবে না; আমি হলে ওইদিনই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটা স্যালুট মেরে দেখা করতাম। তখন তিনি হয়তো বলতেন কী কমিশনার বা আইজিপি? আমি তখন বলতাম, আমার তো পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে। সত্য স্যার, কেউ কথা শুনছে না। কেউ জনগণের বিরুদ্ধে যেতে চাচ্ছে না। এগুলো বলে আসতাম আর ফোর্সকে বলতাম- তোমরা জনগণের ওপর গুলি চালাবা না এবং তাদের পাশে দাঁড়াবা। এই কাজটা মামুন করলে আজ হিরো হয়ে থাকতেন। তিনি  কেন করেননি জানি না। একটু ভীতু টাইপের। পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল, হারুন এদের বিরুদ্ধে যেতে পারতেন না।

ঢাকা মেইল: ডিএমপিতে কত বছর চাকরি করেছেন?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: ডিএমপিতে ১২ বছর চাকরি করেছি। আওয়ামী লীগ এসে ২০০৯ সালে আমার চাকরি কেড়ে নেয়। তখন আমি ডিআইজি হয়েছিলাম। পরে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমি কোনো দিন কোনো দল করিনি। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েছি। কোনোদিন একটা মিছিলেও যাইনি। নিরপেক্ষতার দিক থেকে আমি শতভাগ।

ঢাকা মেইল: আপনার সাহস আসে কোথায় থেকে?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আমার নীতি-নৈতিকতাই আমার সাহস এবং অনুপ্রেরণার জায়গা। আমি অন্যায় করি না এবং প্রশ্রয়ও দিই না। আমি কখনো অন্যায় করবও না। আমাকে দিয়ে কেউ অন্যায় কাজ করাতে পারে না।

ঢাকা মেইল: শোনা যায় আপনার ছেলে-মেয়েদের আপনি পড়িয়েছেন। 

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: হ্যাঁ। এটা ঠিক। ছেলে-মেয়েদের আমি নিজে পড়াশোনা করিয়েছি। শুধু ছেলে-মেয়েদের না আমার দুই ছোট ভাইকেও। একজন পিএইচডি করেছে এখন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের (অস্ট্রেলিয়া) অধ্যাপক। আরেকজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এখন ওরা সিডনিতে থাকে। আমার ভাতিজি এবং কাজিন (চাচার দিক থেকে) আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে, এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। আমার বউকেও আমি পড়াশোনা করিয়েছি। বাচ্চাদের কোনো টিউশনিতে দিইনি। আমার ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি অনেক ভালো পারে, আমি তাদের শিক্ষক ছিলাম।

একবার আট লাইনের একটা কবিতা ইংরেজিতে লিখেছিলাম। তার জন্য আইজিপি স্যার আমাকে ডিনার করিয়েছিলেন। চাকরি ছিল না। খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আষাঢ় মাস। তখন একটু আবেগপ্রবণ হলাম, ওই সময় কবিতাটা লিখেছি। তখন লিখে লিখে আইজি স্যারকে পাঠাই। আর লেখার মাঝখানে তিনি বলেন, আমি অভিভূত এই আট লাইনেই। আমি এবং আমার তিন চার কলিগ মিলে ডিনার করে আসছি। এরপর আমি আর কবিতা লিখিনি। তবে আমি খুব আবেগপ্রবণ এবং মানবিক। আমি নড়াইলের এসপি ছিলাম। তখন বলেছিলাম, আমার বাংলো এবং অফিসে কোনো লোক এসে ফেরত যাবে না। যখনই কেউ আসবে, তখনই আমি সেবা দেব। রাত দুইটা হলে রাত দুইটা। আমি ঘুমিয়ে থাকলে উঠিয়ে দিবা।  আমার দরজা সবসময় খোলা।

আরও পড়ুন

‘সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ ব্যবস্থা নেওয়া, বিবৃতি নয়’

সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলো একমত হলেই বাস্তবায়ন, না হলে নয়: বদিউল আলম

এরপর আমার জীবনে অনেক শিক্ষা হয়েছে। নড়াইলের মানুষ, ২০ কিলোমিটার দূর থেকে সকালে ফজরের নামাজ পড়ে, নাস্তা করে রওয়ানা দিতো। লোকজন জিজ্ঞেস করত, কোথায় যাচ্ছো, বলত এসপি কোর্টে যাচ্ছি। এসপি সাহেব যে বিচার করে দেবে, তাই হবে। দুই পক্ষ আসত, জমি-জমার ঝামেলা নিয়ে। দাঁড়িয়ে বলত, স্যার আপনি যা করবেন, তা-ই। আমি সবার সামনে বলতাম, আপনি কোর্টেও যাবেন না, আবার থানাতেও যাবেন না। থানাতে গেলেও ওরা আপনাকে হ্যারেসড (হয়রানি) করবে বা টাকা চাইবে। আর কোর্টে গেলে উকিল রাখা লাগবে। একবার উকিলরা আমার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিল। আমি বললাম, আমার কাছে আসো, আমি বিচার করব। লোকে তা মেনে নিতো।

ঢাকা মেইল: আপনি এখন ডিএমপির প্রধান। আপনার দরজা কি এখনো খোলা?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আমি চেষ্টা করেছি, তবে এখন সেই কাজগুলো করতে পারি না। ছয়-সাত মাস রাস্তায় এত ঝামেলা, অন্যদিকে মাথা ঘামাতে পারিনি।

ঢাকা মেইল: ইদানীং মব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চর্চা হচ্ছে।  অনেকের দাবি, মব নতুন কিছু নয়, অনেক আগ থেকে হয়ে আসছে। আসলে মব বলে কিছু আছে? এ বিষয়ে পুলিশের অবস্থান কি?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: রাত দুইটা-আড়াইটা বাজে বাসায় গিয়ে চাঁদা চায়। বাড়ি দখল করতে চায়। যাদের টাকা পয়সা আছে, সেদিকে নজর দেয় এক শ্রেণি। পুলিশ আছে, আইন আছে, আদালত আছে। জোর করে এগুলো করতে পারে না। ছেলে-পেলেগুলোর অল্প বয়স। গুলশান থেকে গ্রেফতার রিয়াদের বাসা থেকেই আড়াই কোটি টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছে। আমি তখন গুলশানে মাগরিবের নামাজ পড়ছিলাম। ওসি গিয়ে বললো, স্যার! এরকম ব্যাপার। স্যার! ছেলেটা গতকাল ১০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে, আজকে আবার ৪০ লাখ টাকার জন্য আসছে। কী করবো। বললাম, ধরে নিয়ে আসো। তারপর ধরে নিয়ে আসছে। মোহাম্মদপুরের সমন্বয়ক রাব্বিকে ধরা হয়েছে। পরে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। 

ঢাকা মেইল: মব নিয়ে ডিএমপির বার্তাটা কী?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: পরিষ্কার কথা, কোনো মব হবে না। মব হলেই মামলা, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক কোনো আলোচনা হবে না এবং হচ্ছেও। ডাকাতি মামলাও দেওয়া হচ্ছে। ওসিদের বলা আছে, কারও বাড়িতে মব করলে বা রাতে প্রবেশ করলেই ডাকাতি মামলা হবে। সেইসঙ্গে গ্রেফতার করা হবে।

DMP4
পুলিশে একজন সৎ ও চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত শেখ সাজ্জাত আলী। ছবি: ঢাকা মেইল

ঢাকা মেইল: ‘কল টু কমিশনার’ আর জিডি হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটার কতটুকু অগ্রগতি?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আমি নির্দেশ দিয়েছি। থানায় লোক দিয়েছি এবং আমরা মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছি। রেকর্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিসার কাজ করা শুরু করবে। কী করল আর না করল বড় কথা নয়। বড় কথা হলো- তাকে রেসপন্স করতে হবে। ঢাকার থানা তো বেশি দূরে না। তবু আমি এক ঘণ্টা সময় দিয়েছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ যাবে এবং ঘটনার ওপর ভিত্তি করে মামলা হলে মামলা।

ঢাকা মেইল: এত মানুষের শহর, নানা ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে।  মহানগরের মানুষের জন্য ডিএমপি কমিশনারের বার্তা কী?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আমার চেষ্টার কোনো কমতি নেই। ঢাকাবাসীর কাছে আমাদের বার্তা হলো- ঢাকাবাসী নিজেরাও যেন সচেতন থাকেন। ব্যবসায়ী সোহাগকে এভাবে মারা হলো, দুই-তিনশ লোক দাঁড়িয়ে সেটি দেখল। কেউ এগিয়ে এলো না। ২০ বছর আগেও এভাবে দেখত না, সবাই বলত আগে ধর। দুই-তিনশ লোক খালি একবার যদি বলত ধর, তাহলে এমন ঘটনা ঘটাতে পারতো? নির্মমভাবে মারা হয়েছে।

আপনাকে মেরে ফেললে সবাই দাঁড়িয়ে ভিডিও করবে। একটু ‘ধর’ শব্দটা বলে না।  আপনারা সবাই মিলে আসুন, এই শহরকে নিরাপদ করি।  সেইসঙ্গে একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করি। পুলিশ সবকিছু করতে পারবে, এটার ওপর ভরসা রাখলেও তো হবে না। ঈদের সময় পুলিশেরও তো ঈদ আছে। আর এই শহর তো একেবারে নিরাপদ না।  আমরা বলি, আপনার প্রতিবেশীকে বলে যান এবং তারা যেন খেয়াল রাখে। সিঙ্গাপুরে একে অপরকে সহযোগিতা করার নীতি আছে এবং একজন আরেকজনের খোঁজ-খবর রাখে। আপনি ছুটিতে যেতে পারেন এবং বিদেশ যেতে পারেন। পাশের বাসার দায়িত্ব আছে খেয়াল রাখার।

ঢাকা মেইল: সামনে নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তারাও নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইবে। সেক্ষেত্রে ডিএমপির প্রস্তুতি কী?

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আমরা কিছুদিন আগে মিটিং করেছি।  আমাদের সহকর্মী বা আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন উঠলে আমরা থাকব না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে কি না সেটি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। আর আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন বানচাল করতে চায়, এরকম জনবল তাদের আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি যাই হোক, আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। পুলিশের মোরাল এখন শতভাগ ঠিক হয়ে এসেছে।

ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শেখ মো. সাজ্জাত আলী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

বিইউ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর