বিচিত্র শহর ঢাকা। বিচিত্র সব মানুষ, বিচিত্র খাবার-দাবার। এই খাবার-দাবারের প্রসঙ্গ এলেই কানে বাজে পুরান ঢাকার অলিগলির হাঁকডাক, নাকে লাগে তন্দুরের ঘ্রাণ, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্রেতাভরা দোকানপাট আর গাঢ় চায়ের কাপ। সেই খাবারের ভিড়ে বাকরখানি অন্যতম।
এ যেন শুধু রুটি নয়, এক সামষ্টিক স্মৃতি, এক বিশাল শহরের নিজস্ব স্বকীয়তা, এক টুকরো ইতিহাস। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবাবী গল্প, আর্মেনীয় কিংবদন্তি বণিকের গল্প, তন্দুরঘরে রাতভর জেগে থাকা কারিগরদের জীবন সংগ্রাম, আর প্রবাসে থাকা মানুষের মমতায় মোড়া স্মৃতি।
বিজ্ঞাপন
‘চায়ের টেবিলে বাকরখানি না থাকলে আড্ডা জমে না’- এই বাক্যটি পুরান ঢাকায় যেমন সত্য, তেমনই সামাজিক ভাবেও যেন প্রযোজ্য। এই খাবারটির শুরুটা নিয়ে লোকমুকে শোনা যায় নানা গল্প। মুঘল আমলে ঢাকার নবাবী দরবারে যে বিলাসী খাদ্যসংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল, তার সঙ্গে এই রুটির যোগ ছিল।

লোকমুখে শোনা যায়, আর্মেনীয় বণিক আঘা বাকর নাকি প্রিয় নৃত্যশিল্পী ‘খানি’র স্মরণে এমন এক রুটি বানিয়েছিলেন, পরবর্তীতে যার নাম হয়ে যায় ‘বাকর-খানি’। যদিও এই গল্পের সত্যতা নিয়ে তর্ক আছে। পুরান ঢাকার রাতবাজারে হাঁটতে হাঁটতে যখন তন্দুরের সামনে দাঁড়ানো হয়, তখন আঘা বাকরের ইতিহাস যেন সত্যি হয়ে ওঠে।
যেভাবে তৈরি হয় বাকরখানি
বিজ্ঞাপন
বাকরখানি সাধারণ কোনো রুটি নয়, এটি রুটি জাতীয়, তবে ভাজার পরে রুটি বলে সম্বোধন করা কঠিন । ময়দা, ঘি, কখনো দুধ, কখনো সামান্য চিনি, এলাচ, দারুচিনি- সব মিলিয়ে তৈরি হয় বাটারের মতো নরম এক মণ্ড। এই মণ্ডকে বারবার মাখানো, ভাঁজ করা, আবার মাখানো- এই ভাবে করার মধ্যে লুকিয়ে থাকে স্তর সৃষ্টি, যা বেকিংয়ের তাপে গিয়ে ভেতরে দেয় মসৃণতা আর উপরে শক্ত আস্তরণ। তন্দুরের মুখে যখন গোল চাকতির মতো মণ্ড গভীরে গিয়ে আটকে থাকে, আগুনের তাপে তার গায়ে জন্মায় সূক্ষ্ম বাদামি দাগ, যার প্রতিটি দাগ অভিজ্ঞ কারিগরির স্বাক্ষর।
ইসলামপুরের এক তন্দুরঘরে রাতের ডিউটি করা কারিগর সেলিম মিয়া বলেন, ‘ফজরের আজানের আগেই আমাদের কাজ শুরু করতে হয়। মণ্ডটা কেমন হলো, তাপটা কেমন দিলাম- সবকিছুকেই হাতের সঠিক মাপে আর চোখের আন্দাজে করতে হয়। একেক সময় একেক রকম বাকরখানি বানাতে হয়। কিন্তু মানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না।’

রুচির ভিন্নতা ও বাকরখানির প্রকারভেদ
বাকরখানির ধরন-ভেদে বদলায় টেক্সচার ও সুবাস। শুকনা বাকরখানি অত্যন্ত নরম এবং মোলায়েম। চায়ের সঙ্গে ডুবিয়ে খেলে নরমভাবে ভাঙে, কামড়ে ধরে না, মুখে মিশে যায় খুবই দ্রুত। মিষ্টি বাকরখানির মধ্যে দুধ-ঘি-চিনির ভারসাম্যে জন্ম নেয় খসখসে এবং তুলনামূলক শক্ত ভাব। চায়ের সঙ্গে ডুবিয়ে খেলে ভাঙে নরমভাবে, মুখে মিশে যায় ধীরে ধীরে।
নোনতা সংস্করণে কালোজিরা, লবণ আর হালকা মশলার ছোঁয়া যেন বিকেলের হালকা হাওয়া, মিষ্টিকে প্রশমিত করে দেয়। ‘কাশ্মীরি’ নামে যে বিলাসী সংস্করণটি বাজারে পরিচিত, তার মধ্যে এলাচ, দারুচিনি, কখনো বাদামকুচি, কখনো তিল ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে তৈরি হয় উপযোগী এক রুটি, যার দাম একটু বেশি হলেও চাহিদা প্রতি মৌসুমেই চড়া। এছাড়া বাকরখানির আরও প্রকারভেদ আছে যেমন- তিলে ভাজা, পনিরের, বাদামের ও দুধকাচ্চা (ছোট সাইজ)।
চকবাজারের প্রবীণ বাসিন্দা সফিউল্লাহ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বাবার মুখে শুনেছি নবাবী আমলে এই রুটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমরা জন্মের পর থেকেই দেখছি ‘চা মানে বাকরখানি, আর বাকরখানির সঙ্গে আড্ডা’।’

চকবাজারের দোকানদার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘শীতে বাকরখানি বেশি চলে। তবে সারা বছরই সকল প্রকার বাকরখানি বিক্রি হয়। এর মধ্যে শুকনো আর মিষ্টিটাই মানুষ বেশি কিনে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সবে শেষ- এমন একজন উদ্যোক্তার দোকানের সন্ধান পেলাম। তবে দোকানে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। তার দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, প্রায় সব রকমের বাকরখানি এই দোকানে তৈরি হয়। দিনে প্রায় ২০-৫০ কেজি বাকরখানি দোকানটিতে বিক্রি হয়। ফেসবুকে তার বাকরখানির পেজ রয়েছে, সেখানেই অধিকাংশ বিক্রি হয়। ফেসবুকে অর্ডার পেলে সেদিনই তাজা বানিয়ে দেওয়া হয়।
বাকরখানি কিনতে আসা আরিফ হাসান নামে একজনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। বাকরখানি কিনে গ্রামে নিয়ে যাবেন।
আরিফ হাসান বলেন, ‘অনলাইনে অনেক বাকরখানি কিনেছি, ঢাকায় যেহেতু এসেছি তাই দোকানে এসে গরমটা কয়েক প্রকারের কিনলাম। পরিবারের সঙ্গে চা দিয়ে খাওয়া যাবে। পড়াশোনার ফাঁকে, বিকালে অথবা যেকোনো সময়েই এসব খাওয়া যায়।’
পুরান ঢাকার সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, মিলাদ, ঈদের সকাল) বাকরখানি
বাকরখানি ঢাকাইয়া সামাজিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিয়ের বাসরঘরে নাশতার ট্রেতে, মিলাদের মেঝেতে বিছানো চাদরের পাশে, ঈদের সকালে নামাজে যাওয়ার আগে এই খাবারটি খাওয়ার চল রয়েঝে সেখানে।
আজিমপুরের গৃহিণী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন বাসায় বেড়াতে এলে চায়ের সঙ্গে বাকরখানি দেওয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চারা সবসময় খায়। সকালে উঠেই বাকরখানি খেয়ে পড়তে বসে, তারপর নাস্তা তৈরি করে দেই।’
সামাজিকতা মানে যে শুধুই নিয়মকানুন নয়, বরং পরিবারের স্মৃতি ও স্বাদের ধারাবাহিকতা, বাকরখানি তার এক জীবন্ত প্রমাণ। কোনো কোনো পরিবারে অতিথিকে বিদায়ের সময় কৌটায় করে তুলে দেওয়া হয়, যেন স্মৃতির সঙ্গে স্বাদটাও বাড়ি ফিরে যায়।
কথায় কথায় জানা গেল, পুরান ঢাকার যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা দেশে এলে বিদেশে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সময় বাকরখানি সঙ্গে করে নিয়ে যান।

এদিকে পুরান ঢাকায় জন্ম হলেও বাকরখানির বিস্তার এখন বিভিন্ন জেলাতেও। ময়মনসিংহের দোকানে ‘ঢাকাইয়া বাকরখানি’ নামের সাইনবোর্ড, খুলনায় ‘চকবাজার স্পেশাল’- এভাবে প্রসারিত হয়েছে সারাদেশে।
বাকরখানি ঘিরে জীবিকা
বাকরখানির পেছনে আছে একটি অব্যক্ত অর্থনীতি। (ময়দা, ঘি, দুধ) কাঁচামালের দাম, জ্বালানির দাম, তন্দুরের কাঠ-কয়লা বা গ্যাস, কারিগরদের মজুরি, দোকানের ভাড়া, উৎসবে বাড়তি শ্রমশক্তি- সব মিলিয়ে এক ক্ষুদ্র শিল্প। ঈদের আগে, শবে বরাতে, বিয়ের মৌসুমে দোকানগুলো রাতভর খোলা থাকে। সরবরাহের জন্য আগাম অর্ডার নেওয়া হয়। স্থানীয় কুরিয়ার, বাস কাউন্টার, কখনো উবার-পাঠাও রাইডেও পাঠানো হয় বাক্সভর্তি বাকরখানি।
লালবাগের কারিগর আবদুল মালেক বলেন, ‘আমাদের দাদুর আমল থেকে পেশা। বিভিন্ন সময় দাম ওঠানামা করে, কিন্তু মানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। যুগের পর যুগ ধরে মানুষের আস্থাই আমাদের মূলধন। এই আস্থাই বাজারকে টিকিয়ে রাখে। এই বাজারেই আমাদের জীবিকা হয়।’

ডিজিটাল যুগ বাকরখানিকে দিয়েছে নতুন চেহারা। কাগজের ঠোঙার পরিবর্তে এখন বিভিন্ন রকমের বৈয়ামে দোকানের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হয় এই খাবার। সেসব বৈয়াম আবার বায়ুরোধক করে পাঠানো হয়। ফেসবুক পোস্টে আকর্ষণীয় ছবি, ‘অথেনটিক, ট্যাগ, ক্যাশ-অন ডেলিভারি- সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার বাকরখানি এখন নতুন প্রজন্মের নিউজফিডে।
যেকোনো ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রথম শর্ত মান। অতিরিক্ত শর্টকাট, সস্তা উপকরণ, বেকিংয়ে তাড়াহুড়ো- সবই স্বাদ নষ্ট করে।
তরুণ উদ্যোক্তা শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ‘বাকরখানির মতো পণ্যকে স্থানীয় পরিচয় হিসেবে সংরক্ষণ করা দরকার। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি তার একটি পথ হতে পারে। এতে রেসিপি-আচার, উৎপাদনের অঞ্চল ও ঐতিহাসিক দাবি- সবই কোনো না কোনো কাঠামোর মধ্যে সংরক্ষিত হবে। তবে কাগজে স্বীকৃতি নয়, কারিগরের হাতে মানটাই আসল।’
একজন শিক্ষক যিনি ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, তার মূল্যায়ন, ‘বাকরখানি আসলে একটি ‘সামাজিক আর্টিফ্যাক্ট’। এতে ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই মধ্যবিত্তের আত্মমর্যাদা, সম্পর্কের ভাষা, অতিথি পরায়ণতার অনুশীলন। এই শহরের স্বাদ বুঝতে হলে একদিন চকবাজারে গিয়ে চা-বাকরখানি খেয়ে আসতে হবে। বাকরখানির ভিজ্যুয়াল নন্দনসৌন্দর্যও কম নয়। এক কাপ চায়ের পাশে যখন একটি গোল বাকরখানি খাওয়া হয়, তখন মনে হয় সেটি পুরান ঢাকার নিজস্ব রূপ।’

সময় বদলায়, খাবারের ধারা বদলায়। ফাস্টফুডের ঢেউ তরুণদের জিভে অন্যরকম স্বাদ জাগিয়েছে। তাই বাকরখানির সামনে প্রশ্ন, কীভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে? উত্তরটা হয়তো নতুন প্যাকেজিং, নতুন বাজার, স্টোরিটেলিং আর ধারাবাহিক মানের মধ্যে। নকলের ভিড়ে অথেনটিকিটির দাবি শক্ত করে বলতে হবে।
অনেক শহরই নিজেদের পরিচয় বানায় সেতু, নদী, বা কোনো বিখ্যাত ইমারত দিয়ে। ঢাকারও আছে লালবাগ, আহসান মঞ্জিল, আর্মেনিয়ান চার্চ। কিন্তু খাবারই যে এখানে পরিচয়ের বড় মাধ্যম, তা মেনে নিলে বাকরখানির স্থান খুব উপরে।

চা-ধোঁয়ার ভেতর এক টুকরো শহর
বিকেলের পর শহরের বাতাসে একটু আলস্য নামে, দোকানের কাউন্টারে রাখা কাঁচের বৈয়ামে রোদ পড়ে, ভেতরে থাকা বাকরখানিগুলো যেন সোনালি আভায় হাসে। একটি টেবিলে তিন প্রজন্ম দাদা, বাবা, নাতি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।
বাকরখানি একটি খাবার, কিন্তু তাতেই শেষ নয়। এটি এক ধরনের সামাজিক ভাষা। এটি পরিবারকে এক টেবিলে ডাকে। এটি পুরান ঢাকার ঘরোয়া রসদের গন্ধকে শহরের কেন্দ্রস্থলে এনে রাখে। এটি প্রবাসীর হৃদয়ে সেতুবন্ধন তৈরি করে।
নবাবী কিংবদন্তি, আর্মেনীয় বণিকের গল্প, তন্দুরঘরের ঘাম, দোকানের সামনে ভিড়, উৎসবের আলো সবকিছু মিলে বাকরখানির স্তরগুলো তৈরি হয়েছে, যেমন মণ্ডের স্তর বেকিংয়ের তাপে ধীরে ধীরে উঠে আসে। এর মধ্যে কামড় বসিয়ে আমরা যে স্বাদ পাই, সেটি কেবল চিনি-ঘি-দুধের নয়, সেটি এই শহরের যুগ যুগের ইতিহাস।
এম/এএইচ

