কথা ছিল চোখে থাকবে সাফল্যের আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন, কাঁধে থাকবে বই-খাতার ব্যাগ। ক্লাস রুমে সেই বই-খাতার ঘ্রাণে উড়ে-বেড়িয়ে, আনন্দ-হাসিতে শিখবে জীবনের পাঠ। কিন্তু বাস্তবতা যেন নিষ্ঠুর। রাষ্ট্র যেন নির্ভার! পাঠশালা নয়, ইট-পাথরের জঞ্জালের শহরে গণপরিবহনে জীবনের শিক্ষা নিচ্ছে তিন বোন। এই সমাজ তাদের নাম দিয়েছে পথশিশু!
মাহিমা, মারিয়া আর ফারিয়া। বয়স যথাক্রমে আট, ছয় আর চার। এই তিন বোনের দিনের প্রথম পাঠ শুরু হয় যাত্রীবাহী বাসের ভেতরে, হাতে কটনবার আর কলম নিয়ে। পাঠশালা তাদের জীবনে নেই, আছে শুধু শহরের রাস্তাঘাট আর অনবরত ছুটে চলা। গণপরিবহন-যেন হয়ে উঠেছে তাদের খোলা আকাশের স্কুল, যেখানে শেখানো হয় সংগ্রাম আর টিকে থাকার পাঠ।
বিজ্ঞাপন
মায়ের সঙ্গে রাজধানীর এক বস্তিতে নানা-নানির বাড়িতে থাকে তারা। বাবা নেই। মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। দিনভর অন্যের সংসারে ঘর-মোছে, বাসন মাজে। আয়ের হাত ছোট হলেও পেটের চাহিদা বড়। তাই শিশু বয়সেই পণ্যের ঝাঁপি হাতে পথে নামতে হয়েছে তিন বোনকে। প্রতিদিন ভোরে মায়ের সঙ্গে ঘর থেকে বের হয় তারা। কিন্তু মা আলাদা পথে যায়, আর তিন বোন একসঙ্গে উঠে পড়ে বাসে।
রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে বায়তুল মোকাররম, আবার ফিরে আসে উল্টো পথে। সেই যাত্রাপথেই তাদের ব্যবসা, তাদের জীবিকার লড়াই।
কটনবার, কলম, কখনো ছোট্ট খেলনা—এই সামান্য পণ্যের দাম মাত্র দশ টাকা। কিন্তু বিক্রির জন্য শুধু পণ্য নয়, লাগে সাহস, অভিজ্ঞতা আর আবেগঘন আবেদন।
বিজ্ঞাপন
বাসে উঠেই তারা বলে ওঠে, 'ভাইয়া, একটা নেন মাত্র ১০ টাকা'। কথার সুরে থাকে মায়া, চোখে থাকে অনুনয়। বড় বোন মাহিমা সবচেয়ে সাহসী, কথাবার্তায় সাবলীল। সে বলল, ‘মা মানুষের বাসায় কাজ করে। আমরা কেউ স্কুলে যাই না। বাসে করে ঘুরি, বিক্রি করি। কেউ নেয়, কেউ নেয় না। ভালো বিক্রি হলে রাতে ভালো খাই, না হলে যা থাকে তাই খাই।’
মারিয়া তুলনামূলক চুপচাপ, কিন্তু বিক্রির সময় বড় বোনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট ফারিয়া এখনো কথায় তেমন পারদর্শী নয়, কিন্তু বোনদের হাত শক্ত করে ধরে রাখে যেন এই ব্যস্ত শহরের ভিড়ে হারিয়ে না যায়। তার চোখেও বোঝা যায় বিক্রির তাগিদ-খিদে আর প্রয়োজনের শেখানো তাড়না।
যাত্রীরা নানা প্রতিক্রিয়া দেখান। কেউ মায়ায় কিনে নেন, কেউ কিছু টাকা দিয়ে দেন, আবার কেউ বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন।
বায়তুল মোকাররমের কাছে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো যাত্রী মানিক হোসেন বললেন, ‘প্রতিদিন দেখি এরা ঘোরে। এত ছোট ছোট মেয়ে। একটা তো চার-পাঁচ বছরও হবে না। কষ্ট লাগে। এভাবে তো কোনো শিশুর বড় হওয়া উচিত নয়।’
এ শুধু মাহিমা, মারিয়া ও ফারিয়ার গল্প নয়। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন হাজারো শিশু একই জীবনের চাকা ঘোরায়। কেউ ফুল বিক্রি করে, কেউ খাবার, কেউ করে ভিক্ষা।
ইউনিসেফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লক্ষ শিশু ‘স্ট্রিট সিচুয়েশনে’ আছে। যার মধ্যে ঢাকাতেই ৭৫ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার শিশু। কারও কারও মাথার ওপর পরিবার আছে। রোজগারের জন্য রাস্তায় নামতেই হয়। কারও আবার জীবন পুরোপুরি ভারমুক্ত।
তাদের প্রতিদিনের জীবন মানেই ঝুঁকি। খাবারের অভাব, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, নিরাপত্তাহীনতা-তাদের নিত্য দিনের বিষয়। বৃষ্টির দিনে ভিজে কাপড়ে বিক্রি করতে হয়, গরমের দিনে দমবন্ধ বাসের ভেতরে ঘুরতে হয়। কখনো যাত্রীদের বিরক্তি, কখনো কনডাক্টরের ধমক-সবকিছুর মাঝেও লড়াই থামে না, কারণ বিক্রি না হলে সেদিনের খাবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শৈশবের রঙিন স্বপ্ন তাদের নেই। পাঠশালা তাদের জীবনে শুধু গল্পের মতো শোনা শব্দমালা। খেলার মাঠ, গান, আঁকিবুকি-সব কিছুই যেন অন্য কোনো জীবনের অংশ। তারা বরং শিখেছে কীভাবে চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখা যায়, কীভাবে অচেনা মানুষের চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করতে হয়, কীভাবে খুচরো টাকার হিসাব মিলিয়ে দিনের শেষে ঘরে ফিরতে হয়।
এই শহর প্রতিদিন তাদের দেখে-কেউ সহানুভূতিতে, কেউ উদাসীনতায়। কিন্তু যে সত্যটি চোখে পড়ে না, তা হলো-এভাবেই একে একে হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত শিশুর শৈশব। পাঠশালার আলো-ছায়া থেকে বহু দূরে, তারা বড় হয়ে উঠছে শহরের ধুলো-বালি, হর্ন আর অবিরাম দৌড়ের মধ্যে। যেখানে জীবনের প্রথম ও শেষ পাঠ হলো শুধু বেঁচে থাকা।
এএইচ/জেবি

