রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ড্যান্ডির নেশায় বুঁদ ওদের জীবন, নির্বিকার রাষ্ট্র ও সমাজ!

মাহাবুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

child
ড্যান্ডি আসক্ত পথশিশুরা। ছবি: ঢাকা মেইল

ঢাকার বুকে এক টুকরো সবুজের নীড়। যেন কোনো কাব্যিক সবুজের ছাপচিত্র। জাতীয় সংসদ ভবনের এই প্রাঙ্গণের আশপাশে বিভিন্ন বয়সি মানুষ হাঁটে। কেউ স্বাস্থ্যচর্চায়, কেউ নিছক সৌন্দর্য উপভোগে। কিন্তু এই নান্দনিক স্থানের সৌন্দর্যের মাঝে চোখে পড়বে নীলচে পলিথিনের ব্যাগ হাতে শিশু-কিশোরদের। যারা ব্যাগটি নাকের কাছে চেপে ধরে শ্বাস নিচ্ছে। কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ নুয়ে। চোখ লাল, মুখে বিষাদ, আচরণে একপ্রকার উদভ্রান্তি। ওরা বেঁচে নেই, ওরা ভাসছে... ড্যান্ডির বিষাক্ত ধোঁয়ার ঘোরে। তাদের ভাষ্যে, ‘মধু’র নেশায় মধুময় জীবন! স্বপ্ন দেখি, ‘উড়ি তো পাখির মতোই…’!

রোববার (১৩ জুলাই) তপ্ত দুপুরে আসাদগেট এলাকায় দাঁড়াতেই দেখা গেল একদল পথশিশু নেশার ঘোরে রাস্তা পার হচ্ছে। রোদ-পড়া দুপুরের ভেতরেও যেন ছায়া নেমে আসে এই দৃশ্য দেখে। চারজন কিশোর, দুজন নারী ও একজন কোলের শিশু ড্যান্ডি হাতে নেশায় বুঁদ হয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। কোলের শিশুটিও কিছুটা হাঁটা শিখেছে কেবল। তার হাতেও ড্যান্ডির পলিথিন। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটি বোতল থেকে এক কিশোর অন্যদের প্যাকেটে ড্যান্ডি ঢেলে দিচ্ছেন। কী খাচ্ছো, এমন প্রশ্নে এক কিশোর বলে উঠলো ‘মধু’!


বিজ্ঞাপন


এরপর প্রতিবেদকের হাতে মুঠোফোন দেখে বলে ওঠে- ভিডিও করছেন কেন? এরপর উগ্র হওয়ার চেষ্টা!

পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাত্রীরা অবাক চাহুনিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী একটা অবস্থা!’

এসময় কথা হয় কয়েকজন পথচারীর সঙ্গে। তারা জানান, ঢাকা শহরে এই চিত্র তো স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। এদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবে না। প্রশাসনও দেখে না। কিন্তু নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এসব শিশু-কিশোরই সন্ধ্যার পর উগ্র হয়ে ওঠে। চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।


বিজ্ঞাপন


আশরাফুল ইসলাম নামের এক পথচারী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভাই! এসব দেখে দেখে বিরক্ত। এদের সঙ্গে ভালো করে কথাও বলা যায় না। শাসন করতে যাবেন, তখন দেখবেন পুরো গ্যাং নিয়ে হাজির। এরাই সন্ধ্যার পর চুরি-ছিনতাই করে।’

আরও পড়ুন

ফুটপাত ব্যবসায়ী কামালের আজব ইঁদুরপ্রেম!

১৪ বছরেই চালকের আসনে, গতি যেন প্লেনের!

তাসফিয়া খাতুন নামের এক স্কুল ছাত্রী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে কী বলব ভাই! ওদের এ অবস্থার জন্য তো শুধু ওরা দায়ী না। আমাদের সমাজব্যবস্থাও দায়ী। রাষ্ট্রও এখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে। যখন চুরি ছিনতাই করে তখন পিটিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য যে ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার সেটা কি আছে!’

মাত্র ২০-৩০ টাকায় সহজলভ্য এই ‘ড্যান্ডি’ (আঠা জাতীয় দ্রব্য) কোনো মাদকদ্রব্যের তালিকায় নেই। অথচ চিকিৎসকদের মতে, এর প্রভাব ইয়াবার চেয়েও ভয়াবহ। শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্ক ও দৃষ্টিশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তারা মারামারি, চুরি-ছিনতাইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

Dandy2
নানা অপরাধে জড়াচ্ছে পথশিশুরা। ছবি: ঢাকা মেইল

সংসদ ভবনের মূল ফটকের দিকে এগোতেই দেখা মেলে আরেক কিশোরের। চোখে উদ্ভ্রান্ত চাহনি, আচরণে পাগলামি। কখনো হাসে, কখনো চুপসে যায়, আবার হঠাৎ করে সংসদ ভবনের দিকে দৃষ্টির স্থিরতা। নাম জানতে চাইলে বলে, ‘আগুন!’ এরপর কোনো উত্তর না দিয়ে নিথর চোখে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ মেঘলা আকাশে দমকা হাওয়া উঠতেই সে যেন আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে—উচ্ছৃঙ্খল অঙ্গভঙ্গি আর হাসিতে জর্জর। যেন তার ভেতরেই জ্বলছে কল্পনার ‘আগুন’। আর এই আগুনেই দগ্ধ হচ্ছে পথশিশুদের ভবিষ্যৎ।

রাষ্ট্র ও সমাজের কি কোনো দায় নেই?

শুধু সংসদ এলাকা নয়, রাজধানীজুড়ে ড্যান্ডিনামের বিষাক্ত ‘মধু’র নেশার কালো ছায়া। অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার। সমাজ নির্বাক। প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্র ও সমাজের কি এখানে কোনোই দায় নেই? দেশের উন্নতি-অগ্রগতির ক্ষেত্রে কি এদের জীবনমানের উন্নতি নির্ভর করে না?

আরও পড়ুন

জীবনযুদ্ধে সংকটের ছায়া, চোখে দিনবদলের স্বপ্ন

স্বপ্ন বোনার দায়, কিন্তু ন্যায্যতার ছেঁড়া চাদর!

বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক (শিক্ষা ও কারিগরি) মো. মাহবুবুর রাব্বানী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা স্কুলের ঝরে পড়া শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করি। কিন্তু পথশিশুদের নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পথশিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাজমুল হাসান রাসেল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নেশা নয়, স্বপ্ন চাই তাদের জন্য। ড্যান্ডির ধোঁয়া নয়, দরকার বইয়ের পাতা। নিরাপদ আশ্রয় আর ভালোবাসার হাত। না হলে, ভবিষ্যতের রাজপথে শুধু শিশুর কান্না ভেসে বেড়াবে। আমাদের উদাসীনতার প্রতিধ্বনি হয়ে।’

এদিকে পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক ফজলুল হক সাজ্জাদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (গবেষণা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অধিশাখা) মো. মাসুদ হোসেনের মোবাইলফোনে একাধিকবার কল করেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এমআই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর