ঘড়ির কাটায় তখন সময় রাত সাড়ে ১১টা। বুধবার রাজধানী ঢাকার গাবতলি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি কারখানার সামনে ময়লা পোশাকে বসে থাকতে দেখা যায় দেলোয়ার হোসেনকে। তার বয়স মাত্র ১২ বছর। সূর্য ওঠার আগেই সে জেগে ওঠে প্রতিদিন। শুরু করে কাজ। কাজের ভারে ক্লান্তিও হার মানে। মধ্য রাতেও যেন জেগে থেকেই দেখতে হচ্ছে দিনবদলের স্বপ্ন।
দেশে দেলোয়ারের মতো আরও ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। যাদের দুরন্ত শৈশবকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করছে সংকটের কালো ছায়া,- এমনটাই বলছে জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ ২০২২’।
বিজ্ঞাপন
রাজশাহীর পবা উপজেলার শিক্ষিত যুবক ইয়াসিন আলী। অভাবের সংসারে টানা-পোড়নের মধ্যেও মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেই পড়াশোনা শেষ করেছেন। এখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা; অপরদিকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে না পারার ক্ষোভ জীবনযুদ্ধে যে সংকট এনে দিয়েছে তা কেবল মাত্র গল্প নয়, স্বপ্ন গড়তে না পারার হাহাকার।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী ইয়াসিন আলীর মতো দেশে প্রায় ৬২ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ বেকার রয়েছে।
এর ঠিক অপরপ্রান্তেই প্রায় ৭ কোটি ৪৯ লাখ শ্রমশক্তি। যাদের জীবনমানে নানা সংকটের কালো ছায়া। একজন দিনমজুর ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে কাজে ছুটে যান। আরেকজন গার্মেন্টস কর্মী তীব্র শব্দের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে মাস শেষে হাতে পান নামমাত্র মজুরি। আরেকজন নারী শ্রমিক চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেন ঠিকাদারের বকেয়া মজুরির জন্য। এটাই শ্রমজীবী মানুষের বাস্তবতা। তাদের শ্রমে দেশ এগিয়ে যায়, অথচ তারাই থেকে যায় অনিশ্চয়তার ছায়ায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য বলছে, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করা মানুষের মধ্যে সিংহভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেখানে নেই শ্রম আইনের সুরক্ষা, নেই নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, নেই কর্ম-নিরাপত্তাও।
অনানুষ্ঠানিকতার চক্রে বন্দি:
বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশই কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। কৃষি, নির্মাণ, হকারি, গৃহকর্ম, ছোট ব্যবসা কিংবা অস্থায়ী কারখানাগুলোতে কাজ করেন তারা। এখানেই তৈরি হয় সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা। যেখানে শ্রমিকের কোনো ছুটি নেই, দুর্ঘটনার কোনো ক্ষতিপূরণ নেই, সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। আর বৃদ্ধাবস্থার নিরাপত্তা প্রায় অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন-
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিমার্ণ শ্রমিক আদিবর রহমান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ঘর-বাড়ি ছেড়ে ঢাকা আছি। তবে জীবিকার তাগিদে একেক সময় একেক জায়গায় কাজ করতে যায়। অনেক সময় মাসের পর মাস বাড়ি যাওয়া হয় না। একরকম যাযাবকের মতো জীবনযাপন করি। কিন্তু আমি যা আয় করি, তা দিয়ে সংসারটা চলে যায়। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা হলে পথে বসা ছাড়া তো উপায় দেখি না।’
ঢাকার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে হকারি করেন সাজেদুল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরাও তো শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিক অধিকার কী? এগুলো আমাদের জানা নেই। একদিন রাস্তায় বের হলে পেটে ভাত জুটবে। না বেরুলে না খেয়ে থাকতে হবে। এভাবেই চলছে জীবন। তবে দিনবদলের স্বপ্ন তো দেখি। কিন্তু তা কি সম্ভব? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি।
নারী শ্রমিকের অধিকার বঞ্চনা:
নারী শ্রমিকদের অধিকার বঞ্ছণার চিত্র আরও জটিল। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ৪২.৭ শতাংশ। এই বিশাল নারী শ্রমিক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বেতন বৈষম্যসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
গার্মেন্টস কর্মী আরিফা বেগম (ছদ্বনাম) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গার্মেন্টেসের কিছু কাজ শিখে অনেক স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম। আমি ঢাকায় গিয়ে কাজ করব, এই এক জেদ ধরে স্বামীর সংসার পর্যন্ত ছেড়েছি। কিন্তু ঢাকায় এসে বঞ্ছনা ছাড়া কিছু পাইনি। এখন বাড়ি ফেরারও পথ হারিয়েছি। এখানে কম বেতনে পশু শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। আর যৌন হয়রানি তো স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বেকারত্বের অভিশাপে শিক্ষিতরা: ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬৩ লাখই বেকার। এই বেকারদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই শিক্ষিত বেকার। যার ২১ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও কোনো কাজে যুক্ত না হওয়া।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৬২ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ বেকার রয়েছে। এই বেকারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগ হচ্ছে, কাজ করতে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছেন। এ রকম মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ২৫ হাজার। যা মোট বেকারের ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হলো, সব যোগ্যতা রয়েছে। তারপরও সপ্তাহে ৭ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছেন। তারা যোগ্যতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে কাজ করতে পারছেন না। এমন জনশক্তির পরিমাণ ২৪ লাখ ৬১ হাজার। যা মোট বেকারের ৩৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তৃতীয় ক্যাটাগরিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরেও চাকরি খুঁজছেন না ১১ লাখ ৭১ হাজার, যা মোট বেকারের ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।
শিশু শ্রম: জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুদের মোট সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার। তাদের মধ্যে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার ৯২৭ জন শিশু কর্মে নিয়োজিত। ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন শিশুশ্রমে এবং ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করছে। দেশের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করছেন। শিশু শ্রমের এই বিশাল বহর কমিয়ে আনতে সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
শ্রম সংষ্কার কমিশনের সদস্য সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, শ্রম আইনে অধিকারটা আছে। কিন্তু প্রচুর শর্তজুড়ে দেওয়া রয়েছে। এই শর্তগুলো যদি শিথিল না করা হয়, তাহলে কিন্তু এই আইনের সুবিধাটা নেওয়া সম্ভব না।
ইএ