সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

যাত্রাবাড়ীতে ময়লা, যানজট ও দূষণে বিপর্যস্ত জনজীবন

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫, ০২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

যাত্রাবাড়ীতে ময়লা, যানজট ও দূষণে বিপর্যস্ত জনজীবন

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ী। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত—চলাচলকারী মানুষের জীবনে যেন যোগ হয়েছে এক অবিরাম ভোগান্তির পালা। যানজট, ধুলাবালি ও দূষণ তো আছেই, তার সঙ্গে এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ময়লা ও বর্জ্যের সমস্যা। চারদিকে উৎকট গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের স্রোত—সব মিলে জনজীবন বিপর্যস্ত।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিয়মিতভাবে ময়লা পরিষ্কারের কার্যকর ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় ২-৩ দিন পর্যন্ত পড়ে থাকে আবর্জনার স্তূপ। এর ফলে সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি, ছড়ায় নানা ধরনের রোগব্যাধি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মানুষজনকে প্রতিনিয়তই এই দুর্গন্ধ ও নোংরা পরিবেশের মধ্যে চলাফেরা করতে হচ্ছে। রাজধানীর টিকাটুলি থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ৬ থেকে ৭টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন রয়েছে। যা মূল সড়কের মাঝখানে এবং হানিফ ফ্লাইওভারের ঠিক নিচে। এখানে বাসাবাড়ি, হোটেল-কারখানা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে স্তুপ করে রাখা হয়।

সরেজমিনে ঘুরে যাত্রাবাড়ী মোড় পুলিশ বক্স, দনিয়া কলেজের সামনেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। এমনকি  ফুটপাত ও ড্রেনের মুখে জমে থাকা পচা-বাসি ময়লা উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


শনিরআখড়া, পোস্তগোলা, ধলপুর—এসব এলাকায় সমস্যা আরও প্রকট। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, ময়লা সংগ্রহের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও স্থানীয়রা রাস্তায়-রাস্তায় ময়লা ফেলে যাচ্ছেন। এতে পথচারীরা চরম দুর্ভোগে পড়ছেন।

508404032_671207426081196_295193515074904149_n
ময়লা জমতে জমতে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়ার অনেক নালা। ছবি: ঢাকা মেইল

স্থানীয় এক দোকানদার আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন এখানে ব্যবসা করি, কিন্তু এই দুর্গন্ধে বসে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অনেকবার অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারণে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। তবে তারা নিয়মিত অভিযানে যাচ্ছেন এবং ময়লা দ্রুত অপসারণে চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন।

আরও পড়ুন-

কোন রঙের ডাস্টবিনে কী ময়লা ফেলতে হয়, জানেন না অনেকেই

পরিবেশবিদদের মতে, যাত্রাবাড়ীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম না থাকলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

জনদুর্ভোগ কমাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। নিয়মিত ময়লা অপসারণ, সঠিক জায়গায় বর্জ্য ফেলার অভ্যাস গড়া এবং সচেতনতা বাড়ানোই হতে পারে এই সমস্যার টেকসই সমাধান।

এছাড়া রাজধানীর প্রবেশমুখ যাত্রাবাড়ী—যেখানে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় যানজট যেন অবধারিত এক যন্ত্রণার নাম। গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার সড়কজুড়ে নিত্যদিনই যানবাহনের দীর্ঘ সারি, হর্নের শব্দ, ধুলাবালি আর জনদুর্ভোগের চিত্র যেন স্থায়ী রূপ নিয়েছে।

jatrabari_jam
যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টার যানজটে ভুগতে হয় প্রতিদিন। ছবি: ঢাকা মেইল

প্রবেশদ্বারেই বিপত্তি

ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রবেশের অন্যতম প্রধান পথ যাত্রাবাড়ী। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার গাড়ি প্রবেশ করে এখান দিয়েই। ফলে সকাল থেকে রাত অবধি এই এলাকায় যানবাহনের চাপ লেগেই থাকে। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষ ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। যাত্রাবাড়ী এখন শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ নয়, বরং হয়ে উঠেছে রাজধানীর দুর্যোগের প্রতিচ্ছবি।

অব্যবস্থাপনা ও রাস্তার সংকট

যাত্রাবাড়ীর প্রধান সড়ক, রেললাইন-সংলগ্ন এলাকাগুলোর রাস্তা তুলনামূলকভাবে সংকুচিত। তার ওপর রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, বাস ও ট্রাক সব একসাথে চলাচল করায় অবস্থা আরও জটিল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের অভাব, আবার কোথাও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতাও যানজট সৃষ্টি করে।

হকার ও অবৈধ পার্কিং

সড়কের দুই পাশে গড়ে ওঠা হকারদের অস্থায়ী দোকান, বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে বাসগুলোর অনিয়মিত পার্কিং যান চলাচলকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে। এতে রাস্তা সরু হয়ে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।

ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ

প্রতিদিন যাত্রাবাড়ী দিয়ে অফিসে যাতায়াত করা ব্যাংক কর্মকর্তা রাকিব হোসেন বলেন, একটা জায়গা পার হতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। রিকশা-ভ্যান, বাস-ট্রাক সব একসাথে চললে তো যানজট হবেই। 

যানজটের মূল কারণসমূহ

১. অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত নগরায়ন

যাত্রাবাড়ী এলাকার রাস্তাঘাট, বাসস্ট্যান্ড ও মার্কেট এলাকাগুলো পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠেছে। সড়কের দুপাশ দখল করে রয়েছে হকারদের দোকান, অবৈধ স্থাপনা ও পার্কিং। ব্যস্ততম সময়গুলোতে এসব কারণে যান চলাচলে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়।

২. বাস-ট্রাকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল

দীর্ঘ দূরত্বগামী বাস, ট্রাক ও মালবাহী যানবাহন যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠানো-নামানো বা পণ্য লোড-আনলোড করে। এর ফলে পথ আটকে যায়, যান চলাচলে ধীরগতি তৈরি হয় এবং সড়কের মাঝেই সৃষ্টি হয় অসহনীয় জট।

৩. রিকশা ও মিশ্র যানবাহন

একই রাস্তায় বাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা চলাচলের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায় যানবাহনের গতি। যেহেতু পৃথক লেন বা নির্দিষ্ট চলাচলপথ নেই, তাই রিকশা ও গাড়ি একসঙ্গে চলতে গিয়ে সড়কে নৈরাজ্য তৈরি করে।

৪. ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতি কিংবা সমন্বয়হীন কার্যক্রম যানজটকে বাড়িয়ে তোলে। কোথাও কোথাও হাতের ইশারায় ট্রাফিক পরিচালনা করতে দেখা যায়, যা আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

আরও পড়ুন-

রাস্তার ময়লা পানি কাপড়ে লাগলে নামাজ পড়া যাবে?

স্থানীয় দোকানদার কামরুল ইসলাম জানান, সারাদিনই হর্ন আর ধোঁয়ার মধ্যে থাকি। দোকানে বসে টিকতে পারি না, ক্রেতাও কম আসে যানজটের কারণে।

পরিবেশ সচেতনতা, ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট সময় ও স্থান নির্ধারণ, ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং হকার উচ্ছেদ—এসব পদক্ষেপ না নিলে যাত্রাবাড়ীর এই অবস্থা আরও নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা সচেতন নাগরিকদের।

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়া এলাকার জনগণ নানা ভাবে অবহেলিত। ময়লা আবর্জনা, দুষণে নাকাল এসব এলাকার বাসিন্দারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

এমআর/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর