দেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সুন্দরবন। অথচ একে সংরক্ষণের জন্য গৃহীত ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ প্রকল্পটি পরিকল্পনার চার বছর পার করেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেনি। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা, অর্থ বরাদ্দে জটিলতা, প্রযুক্তিগত দৈন্যতা ও প্রশাসনিক ধীরগতির কারণে এই প্রকল্প আজ কাগুজে যুদ্ধে পর্যবসিত হচ্ছে।
২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি একনেক সভায় সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। শুরুতে সময়কাল ছিল জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত। বরাদ্দ ছিল ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা। পরে
বিজ্ঞাপন
২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রশাসনিক আদেশে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। বরাদ্দও বাড়িয়ে ১৬৭ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। অর্থায়নের উৎস পুরোপুরি জিওবি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সুন্দরবনের বর্তমান আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৪.০৮ শতাংশ এবং সংরক্ষিত বনভূমির ৪৪ শতাংশ। প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খালবেষ্টিত এই বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী ও ৩০০ প্রজাতির পাখি। ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্য এবং রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এত বিপুল প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণেই ওই প্রকল্প হতে নেওয়া হয়। তবে বনের প্রাণ বাঁচাতে নেওয়া প্রকল্পের স্থবিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল সুন্দরবনের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব হ্রাস, বন অপরাধ দমন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল পারমিট সিস্টেম চালু, এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী বন ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলাসহ বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, প্রকল্পটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাথমিক লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে। পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়।
প্রকল্প অগ্রগতির চিত্র বলছে, মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৪৪.৫১ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৫৫.০৬ শতাংশে এসে থেমে আছে। প্রায় ৭৯টি কার্যক্রম থাকলেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক একেবারেই বাস্তবায়নের মুখই দেখেনি।
বিশেষ করে ‘পারমিট সিস্টেম ও পরিচয়পত্র অটোমেশন’ কার্যক্রমে অগ্রগতি এখনো শূন্য শতাংশ। অথচ স্থানীয় বনজীবীদের জন্য এটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনবান্ধব সুবিধা। একইভাবে নদী ও খাল খননের কাজেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। ‘নদী, খাল ও পুকুর খনন ও পুনঃখনন’ বাবদ বরাদ্দ ছিল ২০ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবায়নের চিত্র এখনও শূন্য।
এছাড়া, গবেষণা কার্যক্রমে বরাদ্দের তুলনায় ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪.৯৯ শতাংশ। প্রশিক্ষণ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ১৩ লাখ ৬৪৪ হাজার টাকা। যেখানে বাস্তবায়নের হার ১৯.২৭ শতাংশ। অথচ প্রশিক্ষণ ছিল বনকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
অন্যদিকে, কিছু কার্যক্রমে তুলনামূলক ভালো অগ্রগতি দেখা গেলেও তাতেও পরিকল্পনাগত দুর্বলতা স্পষ্ট। যেমন, জেটি, গ্যাংওয়ে, ফিল্ড অফিস নির্মাণে ভৌত অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই নির্মাণ হয়েছে প্রকৃতি-বান্ধব পরিকল্পনা ব্যতীত। কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ (CPG)–এর ভাতার অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭৪.৯০ শতাংশ, কিন্তু সদস্যদের দাবি অনুযায়ী ভাতা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের একটি বড় দুর্বলতা হলো তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার না করা। অটোমেশন, ট্র্যাকিং, ডিজিটাল পারমিট, এবং ডেটা বিশ্লেষণ ব্যবস্থা না থাকায় একদিকে যেমন প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আসছে না, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। এখনও পারমিট নিতে ম্যানুয়াল ফরম ও লাইনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যেখানে দুর্নীতির সুযোগও কম নয়।
বনকর্মীদের ব্যবহৃত ট্রলার এখনও কাঠের তৈরি। বর্তমান সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুতগামী ও নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা না থাকায় অপরাধ দমন কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে বনে এখনও ১০ শতাংশের বেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যেসব কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি ছিল—সুন্দরবন দিবস, বন দিবস, জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের মাধ্যমে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা, সেটিও হয়েছে অনেকাংশে কাগজে-কলমে। প্রশিক্ষণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পরিকল্পনা কমিশন তাদের সবশেষ পর্যবেক্ষণে প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাঠামো দুর্বল, অর্থ বরাদ্দ যথাসময়ে অবমুক্ত করা হয় না, মাঠপর্যায়ে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বর্ষাকালীন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কাজের পরিকল্পনা করা হয়। ফলে তা বিলম্বিত হয়। খাল খননের সময় খননকৃত মাটি ব্যবস্থাপনার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। তারা আরও সুপারিশ করেছে যে, শুষ্ক মৌসুমে খাল খনন করে সেই মাটি দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি করা যেতে পারে।
সবমিলিয়ে ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ প্রকল্পটি একটি সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা হলেও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান দুর্বলতা ও কাঠামোগত বিচ্যুতি প্রকল্পটিকে একটি ব্যর্থ মডেলে পরিণত করেছে। পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার এই দূরত্ব যদি অচিরেই কমানো না যায়, তবে শুধু একটি প্রকল্প নয়—বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের সোনার খনি’র ক্ষতি বাড়তে পারে। এমনটাই ভাষ্য সংশ্লিষ্টদের।
এই প্রকল্পের শুরু থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন তো আমি ওটার দায়িত্বে নেই। সুতরাং এ বিষয়ে আমি কথা বলব না।
প্রকল্পের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক ও খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি কয়েক মাস আগে এই দায়িত্ব পেয়েছি। যতটুুক জানি, পারমিট সিস্টেম ও পরিচয়পত্র অটোমেশন দরপত্র জটিলতার কারণে হয় নি। নদী, খাল ও পুকুর খনন ও পুনঃখননটা পাউবো করবে। সেখানেও জটিলতা ছিলো। তবে গত মাস থেকে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের অন্য কাজগুলোকেও এগিয়ে নিতে কাজ করছি।
এমআই/ইএ

