সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সুন্দরবনে মৌয়ালসহ মধু আহরণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ

কামাল হোসেন, খুলনা
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২৫, ১১:৫৯ এএম

শেয়ার করুন:

সুন্দরবনে মৌয়ালসহ মধু আহরণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ

৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা, সময়সীমা হ্রাস, ডাকাতি ও জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী

মধু আহরণে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের ভয় বরাবরই ছিল। এবছর নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডাকাতের উৎপাত। ফলে গত বছরের তুলনায় এবার সুন্দরবনে মধু আহরণ কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এতে বিপাকে পড়েছেন মৌয়ালসহ এই খাতের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীরা। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে মধু না পাওয়ায় অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।


বিজ্ঞাপন


বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুন্দরবন থেকে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টালে, যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ কম। গত বছর প্রায় ৮ হাজার মৌয়াল মধু আহরণে অংশ নিয়েছিলেন, এবছর তা নেমে এসেছে প্রায় ৫ হাজারে।

মধু আহরণ কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। মৌয়ালদের ভাষ্যে, ডাকাত আতঙ্ক ছাড়াও সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণায় মধু আহরণের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। আগে বন বিভাগ তিন মাস মধু সংগ্রহের অনুমতি দিত, কিন্তু গত চার বছর ধরে সেই সময়সীমা কমিয়ে দুই মাস করা হয়েছে।

সুন্দরবনের সুরক্ষায় কাজ করা কয়রা উপজেলার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনে মধু আহরণ কমে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উপকূলীয় এলাকার বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত। সুন্দরবনের মধু জিআই সনদপ্রাপ্ত, যা দেশের জন্য গর্বের বিষয়। এখনই যদি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে শুধু দেশের বাজার নয়, রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়তে পারে।’

খুলনার কয়রা উপজেলার মৌয়াল সোহরাব হোসেন বলেন, ‘ভয়ের কারণে এবছর মধু কাটতে যাইনি। এলাকায় দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছি। বহু বছর সুন্দরবনে যেতাম, এবছর না যেতে পারায় কষ্টে আছি।’


বিজ্ঞাপন


চলতি বছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে গিয়েছিলেন দাকোপ উপজেলার নিতাই নন্দী। তিনি বলেন, ‘ডাকাতদের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই মধু কাটতে যায়নি। এমনিতেই মধু কম, তার উপর ডাকাতের হাতে পড়লে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়াতে হয়। অনেক সময় মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে ধার-দেনা করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছর এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুমে আগেই প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে ফুল কম ফুটছে, আবার ফুল ফুটলেও দ্রুত ঝরে যাচ্ছে। ফলে মৌমাছিরা আগের মতো মধু সংগ্রহ করতে পারছে না। এজন্য সুন্দরবনে মধুর পরিমাণ কমে গেছে।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী,

  • ২০২১ সালে মধু আহরণ হয়েছিল ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল
  • ২০২২ সালে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টাল
  • ২০২৩ সালে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল
  • ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল
  • ২০২৫ সালে আবার কমে হয়েছে ২ হাজার ০৭৬ কুইন্টাল
  • যদিও এবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনের পূর্বাংশে এমনিতেই মধু কম হয়। তার ওপর এবছর ডাকাত আতঙ্কে অনেক মৌয়াল বনে যাননি। ফলে মধু সংগ্রহ কমে গেছে।’

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ. জেড. এম. হাছানুর রহমান বলেন, ‘মৌয়ালদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বনাঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে, পাশাপাশি মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করি আগামী বছর মৌয়ালের সংখ্যা আবারও বাড়বে।’

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর