রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় রাকিবুল হাসান সানি ওরফে ‘পেপার সানি’ (৩২) নামের এক যুবককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১০ জুন) সকালে পল্লবী মিল্লাত ক্যাম্পের ১১ নম্বর সেকশন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন পেপার সানি। এর আগে একই গ্রুপের ফয়সাল নামের আরেক সদস্যও একই চক্রের হাতে নিহত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, রুবেল গ্রুপের লোকজন এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িত। রুবেল গ্রুপের সদস্য জিন্দা, টানা আকাশ, রুবেল, বোমা কাল্লু, কাসরা সোহেলসহ আরও অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
বিজ্ঞাপন
নিহত সানি কালসি এলাকার মোহাম্মদ সোহেলের ছেলে। তিনি স্ত্রীসহ মা-বাবার সঙ্গে ওই এলাকায় বসবাস করতেন।
পেপার সানির বাবা মোহাম্মদ সোহেল অভিযোগ করেছেন, মঙ্গলবার সকালে জিন্দা ও টানা আকাশ মোবাইল ফোনে তার ছেলেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর মিল্লাত ক্যাম্পের ১১ নম্বর সেকশনে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তাকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য ও পল্লবী এলাকায় সন্ত্রাসী বলেই পরিচিত। তাদের উৎপাতে গত ১০ মাস থেকে অতিষ্ঠ পল্লবী এলাকার মানুষ। তারাই পেপার সানিকে হত্যার পর ঘটনাস্থলেই মরদেহ ফেলে পালিয়ে যায়।
নিহতের বাবার দাবি, কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক কারবারে বাধা দেন পেপার সানি। আর এ বাধা দেওয়ার কারণেই তাকে তারা হত্যা করেছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি এমন দাবি করলেও থানা পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য ধরে রাখার জের রয়েছে। যদিও তার পরিবার বিষয়টিকে ভিন্নখাতে নিতে এমন কথা বলছে।
আর এলাকাবাসী বলছে, মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সানির সঙ্গে ওই কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। তাকে হত্যার আগে সন্ত্রাসীরা সেই এলাকায় অস্ত্র নিয়েও মহড়া দেয়। এমন একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যাতে দেখা যায়, মহল্লার একটি সড়কে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থামে। সেটির ভেতর বসে থাকা একজন অস্ত্র (পিস্তল জাতীয় কিছু) বের করে কাউকে ইশারায় ডাকে। পরে গাড়ির কাছে যায় কয়েকজন নারী ও একজন পুরুষ।
সানিকে হত্যার আগে যা ঘটেছে:
এলাকাবাসী ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, পেপার সানির সঙ্গে মাদক কারবারি রুবেল গ্রুপের দীর্ঘদিন থেকে দ্বন্দ্ব চলছিল। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরেই ব্যবসার রাস্তা ফাঁকা করতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসী জানিয়েছে, সানিকে হত্যার আগের দিন একটি সাদা প্রাইভেট কারে মিরপুরের বাঙলা স্কুল ও কলেজের সামনে আসে রুবেল। সেখানে গাড়িতে উঠে বোমা কাল্লু। সেই সময় গাড়িতে ফাজজু নামে এক মাদক কারবারিও ছিল। পরে সেই এলাকায় আধা ঘণ্টার মতো তাদের নিয়ে শোডাউন করে রুবেল। পরে তারা চলে যায়। এরপরের দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডে সময় বোমা কাল্লু, ল্যাংড়া রুবেল ও ফাজজু ছিল। এছাড়াও রুবেলের একজন চালকও ছিল। কিন্তু তাকে কেউ চিনতে পারেনি। হত্যার আগে রুবেল তারই মাদক বিক্রির দায়িত্বে থাকা পারভেজ ও চেতুয়া সনুর সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছে। এমনকি মঙ্গলবার দুপুরেও ল্যাংড়া রুবেল মিরপুর-৬ টেরি ফ্যামিলি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে (বাঙলা স্কুলের বিপরীতে) মিটিং করেছে বলে জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, পারভেজ হলেন রুবেলের মাদক ডেলিভারি ম্যান। অন্যদিকে মিরপুর-১০ এলাকায় ইয়াবার ব্যবসা দেখভাল করেন চেতুয়া সনু। সনু মুসলিম ক্যাম্পের বাসিন্দা।
>> আরও পড়তে পারেন:
গাড়িচালকের ছেলে যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী
মাদক কারবারি রুবেলের উত্থান যেভাবে:
এলাকাবাসী বলছে, রুবেল একজন বিহারী। মিরপুর-১০ ও ১১ এর মাঝামাঝি এলাকার বাসিন্দা। রুবেল আগে রিকশা চালাতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। রাজিব নামে এক যুবকের হাত ধরে মাদকের কারবার শুরু করেন রুবেল। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে ওঠেন কোটিপতি। রুবেল ও সানি এক সময় এক সঙ্গে মাদকের কারবার করতেন। কিন্তু মাদক বিক্রি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্ব চলছিলই। সর্বশেষ সেটি হত্যাকাণ্ডে রূপ নেয়।
যদিও সানির পরিবারের দাবি, সানি ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা ও অটো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
জেল থেকে বেরিয়েই খুনের মিশনে!
এলাকাবাসী জানিয়েছে, পেপার সানি হত্যাকাণ্ডে দুই নম্বর আসামি বোমা কাল্লু সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে বের হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন জেলেই ছিলেন। ল্যাংড়া রুবেলই তাকে সম্প্রতি জামিনে বের করে নিয়ে আসেন। শুধুমাত্র পেপার সানি হত্যা মিশনকে সফল করার জন্য ও তাকে এই মিশনে কাজে লাগাতে জামিন করায় রুবেল। সেই কাল্লু বের হয়েই তার মিশন শেষ এখন এলাকা ছাড়া হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, কাল্লু গা ঢাকা দিয়ে ঢাকাতেই আছেন।
মামলার এজাহারে যা উল্লেখ করা হয়েছে:
এ ঘটনায় পেপার সানির মা রোজিনা বেগম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। সেই মামলায় তিনি ল্যাংড়া রুবেল, বোমা কাল্লু, স্বপন, জিন্দা ও টান আকাশ জড়িত। এ মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, হত্যার আগে পেপার সানিকে স্বপন নামে এক যুবক মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে নেন। সেটি হত্যাকাণ্ডের আগের রাত ১১টার দিকে ঘটনা। ফোনে স্বপন তাকে মিরপুর সাড়ে ১১ তে যেতে বলেন। পেপার সানিকে বলা হয়, তারা সবাই আড্ডা দেবে। এজন্য তাকে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার পর তার ফোন সচল থাকলেও রাতে আর সচল পায়নি তার পরিবার। পরদিন তার লাশ পড়ে আছে বলে তারা খবর পান। হত্যার সময় পেপার সানির দুই পা গামছা দিয়ে বাধা ছিল ও হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে হত্যাকারীরা সানিকে হত্যার পর তার মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোনটি নিয়ে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
পরিবার মামলার এজাহারে আরও দাবি করেছে, তাকে হত্যার দিন সকাল ছয়টার দিকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে ও দুই পা বেঁধে জবাই করেছে ল্যাংড়া রুবেল গ্রুপের লোকজন।
পুলিশ যা বলছে:
এ ঘটনায় পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, এ ঘটনায় নিহতের মা রোজিনা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। তাতে বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা যায়নি। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) এসএন নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, পল্লবীতে পেপার সানিকে তার প্রতিপক্ষের লোকজন হত্যা করেছে। এটি দুই পক্ষের মাদক কারবারের দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
পেপার সানির বিরুদ্ধে থানায় আট থেকে নয়টি মামলা ছিল বলে জানান তিনি।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পল্লবী থানার এসআই হুমায়ুন জানান, তারা আসামিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি।
এমআইকে/এএস