‘গত ১৭ বছরে এমন ঈদ কাটেনি। প্রতিবার খুন-খারাবি, ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির খবর শোনা যেতো। কিন্তু এবার এ ধরনের তেমন কোনো খবর শোনা যায়নি। বিষয়টি সত্যি মিরাকল।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর বসিলা এলাকার মেট্রো হাউজিংয়ের গৃহবধূ নাসিমা আক্তার।
মঙ্গলবার (১০ জুন) বিকেলে তিনি আরও বলছিলেন, ‘প্রতি বছর যখন গ্রামে যেতাম ভয়ে থাকতাম কখন দারোয়ান কল করে বলে- আপা বাসায় চুরি হইছে। কিন্তু এবার ছিলাম নির্ভয়ে। বাসায় ফিরে শুনি এবার ঢাকায় কোনো সমস্যাই হয়নি। বিষয়টি ভাবতে ভালোই লাগছে। কারণ আমরা তো এমন একটি ঢাকাই চেয়েছি।’
বিজ্ঞাপন
শুধু নাসিমা আক্তারই নন, তার মতো অনেক নগরবাসীই এবার ঈদের ছুটিতে ঢাকায় ফিরে স্বস্তির কথা জানাচ্ছেন।
ঢাকা উদ্যানে গত পাঁচ বছর ধরে থাকেন রুবেল সরকার। তিনি বলছিলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম কিশোর গ্যাং আর ছিনতাইকারীদের কারণে। সবশেষ বাসা ছাড়ারও পরিকল্পনায় ছিলাম। কিন্ত এবার ঈদ করে বেশ ভালোই লাগল। বাসার আশপাশে সবাই বলছে, এবার ঈদের আগে-পরে এলাকা নীরব ছিল। লোকজন ঘোরাফেরা করেছে, কিন্তু কেউ কোনো বাধা দেয়নি।’

রুবেলের মতো একই কথা জানালেন মিরপুরের এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো বছর নেই যে মিরপুরে খুন, হত্যা, ছিনতাইয়ের খবর আসে না। প্রতি বছর কমবেশি এই এলাকা সংবাদের শিরোনাম হয়। কিন্তু এবার মঙ্গলবার সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে পেপার সানি নামে একজন সন্ত্রাসী নিহতের খবর ছাড়া তেমন কোনো খবরই নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৭ বছর নগরবাসী এমন ঈদ কখনোই দেখেনি। প্রতি বছর আতঙ্কে কেটেছে তাদের। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। এজন্য তারা অন্তর্বর্তী সরকারসহ নগরবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার পেছনে যারা নানাভাবে কাজ করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
অন্য বছরগুলোতে ঢাকায় ফিরেই অনেকে বাসা বাড়িতে চুরির খবর পেতেন। ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করতেন। এরপর সেই চোরদের শনাক্ত করে গ্রেফতারও করা হতো। এবার তেমন কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, গত ৫ জুন থেকে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। তার আগেই নগরবাসীর কেউ কেউ ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামে চলে গেছেন। ফলে ঢাকা ফাঁকা হয়ে গেছে। সেই ছুটি কাটিয়ে ফিরতে শুরু করেছেন লোকজন। যদিও এখনো ঢাকা আগের মতো সরব হয়ে উঠেনি। চলতি সপ্তাহ পুরোটাই ছুটির আমেজ থাকবে। আগামী রোববার থেকে সবকিছু স্বাভাবিক হবে।
অন্য বছরগুলোতে ঈদের আগে পুলিশ প্রশাসন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানাভাবে বক্তব্য দিয়ে ইঙ্গিত দিতেন যাতে নগরবাসী সচেতন থাকেন। তাদের ঘরদোরের নিরাপত্তা নিজেরাই যেন ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এবার কাউকে তেমন কথা বলতে শোনা যায়নি। বরং নরগবাসীকে নানাভাবে সাহস দিয়েছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
নিরাপত্তা ছাড়াও এবার প্রথম ১২ ঘণ্টায় কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় গত ১২ বছর ধরে থাকেন আলতাফ সরকার। তিনি বলছিলেন, এবারই প্রথম ঈদ কাটল যে সন্ধ্যার আগেই রাস্তাঘাট পরিষ্কার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার নগরীতে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ছাড়াও সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করেছেন। ঈদের আগে প্রতিটি এলাকায় কে কীভাবে টহল দেবেন, কীভাবে তারা ভুক্তভোগীদের সহায়তা করবেন, তার পরিকল্পনা করা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি ও টহলের কারণেই মূলত বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
গুলশান জোনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, তার এলাকায় ঈদের দিন সকাল থেকে প্রতিটি অলিগলিতে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছিল। যেসব বাড়ি, অফিস ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল সেগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে তারা বারবার যোগাযোগ করেছেন। তাদের এটাও বলেছিলেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আভাস পেলেই যেন তারা জাতীয় জরুরি সেবায় কল করে পুলিশি সহায়তা চান। পাশাপাশি র্যাব ও সেনাবাহিনীর সহায়তা নিলেও বলা হয়েছিল।

এবার ঈদকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করাটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মনে করছে পুলিশ। মোহাম্মদপুরের পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তারা এবার মোহাম্মদপুরবাসীকে শান্তিতে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিশেষ করে ঢাকা উদ্যান ও বিহারি ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটেনি। তার নেপথ্যের কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, টহল ছিল বেশি। মাঠে গোয়েন্দারাও সক্রিয় ছিল। ফলে ভয়ে অপরাধীরা তেমন কিছু ঘটাতে পারেনি।
আরও পড়ুন
হঠাৎ ঢাকায় ঈদের সময়ে এমন কম অপরাধ সংঘটিত হওয়ার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে আরেকজন কর্মকর্তা জানান, ঈদের আগে ঢাকার প্রতিটি থানার উদ্যোগে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী ও বিভিন্ন মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হয়েছিল। ফলে সেটির সুফল মিলেছে ঈদে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) এস এন নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের মতো কোরবানির ঈদও নগরবাসী স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারল, এটা খুব ভালো খবর। এবার আমাদের প্রথম ফোকাস ছিল গরুর হাটগুলো। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত আমাদের বাহিনীর প্রত্যেকটি সদস্য গরুর হাটগুলো নিয়ে কাজ করেছে। ঈদের দিন সকাল থেকে ফোকাস ছিল স্বর্ণ মার্কেট, আবাসিক এলাকা ও ব্যাংক বিমা পাড়া। এসব বিষয়কে নজরে রেখে সব অলিগলি সড়কে পুলিশ টহলে ছিল। ফলে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’
এমআইকে/জেবি