বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫, ঢাকা

পুলিশের গুলিতে খালিদের মৃত্যুর পর বাড়িঘর বেচে এলাকা ছাড়ে পরিবার

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৭ মে ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

পুলিশের গুলিতে খালিদের মৃত্যুর পর বাড়িঘর বেচে এলাকা ছাড়ে পরিবার

২০১৩ সালের ৬ মে। তার আগের দিন ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হামলা চালিয়ে তাদের কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় তৎকালীন পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। সেদিন রাতের আধারে প্রাণের ভয়ে অনেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। কিছু আলেম-ওলামা পালিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন। এ খবর জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর তারা যায় কোথায়!

বড় ফোর্স নিয়ে পুরো মাদ্রাসা ঘিরে ফেলতে শুরু করে র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবি। তাদের সঙ্গে মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়া লোকজনের ঝামেলা বাঁধতে শুরু করে। খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে। দ্রুত গ্রামবাসী সেই মাদ্রাসার দিকে এগুতে থাকেন। তখনই পুলিশ, র‌্যাব ও বিজির সঙ্গে শুরু হয় সংঘর্ষ। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সেদিন নির্বিচারে গুলি করে শেখ হাসিনার অনুগত বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সেই গুলিতে নিহত হয়েছিলেন খালিদ সাইফুল্লাহ নামের এক ১৮ বছরের ‍যুবক। 


বিজ্ঞাপন


খালিদ সাইফুল্লাহ সবেমাত্র তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। পরে তার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায়, পরীক্ষায় ভালো জিপিএ পেয়েছেন। কিন্তু সেই খালিদ আর নেই। 

খালিদের নিহতের এই গল্পের পরের গল্পটা আরও করুণ। শুধুমাত্র সন্তান পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন এই কারণে তার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। এলাকা ছাড়ার আগে তাদের সেই জমি-বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল। ‍যা তারা গত ১২ বছরেও কোথাও বলতে পারেননি।

খালিদের পরিবার ডেমরার ডগাইর পূর্বপাড়ায় থাকতেন। ছেলের শোকে বাবা আব্দুল জলিলও কয়েক বছর পর এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। মৃত্যুর আগে তার প্রতিটি রাত কেটেছে পুলিশি ভয় আর গ্রেফতার আতঙ্কে। শেষমেষ তিনি জমি বাড়ি বিক্রি করে নারায়ণগঞ্জে চলে যান। এখন সেই পরিবারটি সেখানেই থাকেন।

আরও পড়ুন-

খালিদ সাইফুল্লাহর মৃত্যুর দিনের ঘটনা তুলে ধরে তার বড় ভাই নাজমুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, “আমি তখন আমার কর্মস্থল স্কুলে ছিলাম। হঠাৎ সকাল সোয়া দশটার দিকে এক সহকর্মী এসে আমাকে খবর দিলো আপনার ছোট ভাই তো মারা গেছে। তার লাশ হাসপাতালে। খবরটি শোনামাত্র হাসপাতালে ছুটে যাই। পাশেই মাজেদা হাসপাতালে গিয়ে দেখি একটি ভ্যানের ওপর তাকে কাপড়ে মুড়িয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পরে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে আমরা দ্রুত লাশটি নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করলাম।”

166062769_809647126574163_4383981298806357682_n-2103300911
নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের সঙ্গে বিজিবি-পুলিশের সংঘর্ষ

তিনি জানান, এ ঘটনার পর নানাভাবে আমার বাবাকে পুলিশ হয়রানি করেছে। তিনি জামায়াত ইসলামীর সমর্থক হওয়ার কারণে পুলিশেরও টার্গেট ছিল। এ কারণে টানা পাঁচ বছর তিনি কোনোদিন বাড়িতে রাত কাটাতে পারেননি। প্রতি রাতেই তাকে বাইরে কাটাতে হতো। 

জমি ভিটে বিক্রি করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন অবশেষে! 

খালিদের ভাই বলছিলেন, “আমি তখন ডেমরায় থাকতাম না। কিন্তু বাবা থাকতো ওই বাড়িতে। পুলিশ বাবাকে নানাভাবে হয়রানি করত। আমরা সব সময় পুলিশের আতঙ্কে থাকতাম। কখন বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। বাবা তখন সেই এলাকায় নিজেকে আর নিরাপদ মনে করলেন না। ফল বাধ্য হয়ে নিজের কেনা জমি, ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসলেন। বাবা বেঁচে থাকলে এখন জানা যেত তাকে কীভাবে পুলিশ কতভাবে হয়রানি করেছে।”
নাজমুলের বাবা মনে করতেন, ঢাকায় থাকতেই তাকে হয়রানির শিকার হতে হবে। এই ভয়ে ও গ্রেফতার আতঙ্কে ঢাকা ছাড়েন তিনি।  

খালিদ সাইফুল্লাহ বাবার বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। কিন্তু তার বাবা কর্মের ‍সুবাদে ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। ছেলের মৃত্যুর পর সেই ঢাকা ছেড়ে উপজেলা শহরে চলে যান।

মামলা করতে চায় পরিবারটি:

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন মুক্ত বাংলাদেশে নিঃশ্বাস ফেলছে খালিদের পরিবার। মনোবল বেড়েছে তাদের। জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে মামলা করতে চান। যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার সুযোগ হয় তারা মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন তার বড় ভাই নাজমুল আলম।

তার ভাইয়ের একটি কথা, “আমার ভাইকে পুলিশ বিনা অপরাধে গুলি করে হত্যা করেছে। সেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
জানা গেছে, খালিদ সাইফুল্লাহ যেদিন মারা যান সেই এলাকায় আরও কয়েজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। যদিও সেই মৃত্যুর আসল সংখ্যা এখনো কারও কাছে নেই।  

এমআইকে/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর