ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের ভয়াবহ পতনের পর চরম জনরোষে পড়ে পুলিশ বাহিনী। স্বৈরাচারী সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অন্যতম সহযোগী হিসেবে জনগণের ক্ষোভ পতিত হয় এই বাহিনীর ওপর। এতে কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে দেশের বেশির ভাগ থানা। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে চলে যান বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর ১৮৭ জন সদস্য কাজে যোগ দেননি।
গত চার মাসে পুলিশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় নোটিশ করেও তাদের কোনো সাড়া মেলেনি। এমনকি তারা কোনো নোটিশের জবাবও দেননি। কাজে যোগ দেবেন কি না তাও জানাননি। ফলে বিধি মোতাবেক পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের এসব সদস্য ও কর্মকর্তার বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে তাদের প্রত্যেককে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। এসব প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ পুলিশের সদর দফতর সূ্ত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কাজে যোগ না দেওয়া ১৮৭ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন ডিআইজি, সাতজন অতিরিক্ত ডিআইজি, দুজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পাঁচজন সহকারী পুলিশ সুপার, পাঁচজন পুলিশ পরিদর্শক, ১৪ জন এসআই ও সার্জেন্ট, নয়জন এএসআই, সাতজন নায়েক এবং ১৩৬ জন কনস্টেবল রয়েছেন। পলাতক কনস্টেবলদের মধ্যে দুজন নারী সদস্যও রয়েছেন বলে জানিয়েছে সদর দফতর।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, কাজে যোগ না দেওয়া ও পলাতক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। পাশাপাশি তাদের গ্রেফতারে আলাদা টিমও গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি, মামলা, বেতন-ভাতাসহ সার্বিক সিদ্ধান্তের বিষয় দেখভাল করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন তারা। তবে এ বিষয়ে পুলিশ সরাসরি কিছু বলছে না।

ইতোমধ্যে যারা বিদেশ পালিয়েছেন তাদের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশের কয়েকজনের বিদেশ পালোনের খবর চাউর হলে অফিসিয়াল পাসপোর্ট বাতিলের সুপারিশ করে সদর দফতর। পাসপোর্ট অধিদফতরে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সেই তালিকা ধরে ধরে পাসপোর্ট বাতিল করছে পাসপোর্ট বিভাগ।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে হত্যা, হামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় আসামি হওয়া পুলিশ সদস্যদের মন্ত্রণালয় থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছে। এর বাইরে যারা আছেন তাদের সাময়িক বহিষ্কারের বিয়ষটি নিয়ে কাজ করছে পুলিশ।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সদস্যরা অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু যারা কোথাও যোগ দেননি, পলাতক রয়েছেন, তারা কিছুই পাচ্ছেন না। এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, যারা পলাতক রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়া বেতন-ভাতা বন্ধ এবং মামলা দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা দেশ থেকে পালানোর খবর ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ পুলিশের দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ কর্মকর্তা এবং সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন বিকেল থেকে গা ঢাকা দিতে থাকেন তারা। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে গা ঢাকা দেন। ওই দিন বিকেলে হারুন পুলিশ সদর দফতরের দেয়াল টপকে সিটি করপোরেশনের কার্যালয় এলাকায় প্রবেশ করেন। পরে সেখান থেকে তিনি লাপাত্তা হয়ে যান।
অন্যদিকে যে ডিবি অফিসে বসে হারুন নানা আটক সাজাতেন সেখানকার কর্মরর্তারাও পালাতে থাকেন। ওইদিন ডিবি ও ডিএমপি সদর দফতর জনশূন্য হয়ে পড়ে। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ থানায় টানা কয়েক দিন কোনো পুলিশ সদস্যই ছিলেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পলাতক পুলিশ সদস্যরা ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি। তারা আদৌ আর কাজে যোগ দেবেন কি না তাও জানাননি।

ধারণা করা হচ্ছে, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ আর দেশে নেই। তাদের বেশির ভাগই দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাদের বড় একটি অংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে অবস্থান করছেন। আবার কেউ কেউ অন্য দেশে চলে গেছেন।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ‘জয় বাংলা’ নিয়ে স্টাটাস দিয়েছেন এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম। তার স্টাটাসের পর সেখানে নানা জন কমেন্ট করতে শুরু করলে সেটিকে তিনি লিমিট করে দেন। কিন্তু গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) থেকে তার ফেসবুক পেজটিও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা করা হচ্ছে, তিনি সেই স্ট্যাটাস হাইড করে দিয়েছেন। এছাড়া ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, খন্দকার নুরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান, সঞ্জিত কুমার রায় ও সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর কোনো খোঁজ মিলছে না।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে ডিবির সাবেক প্রধান হারুনের কোনো সন্ধান না মিললেও তার স্ত্রী মার্কিন নাগরিক হওয়ায় তিনি সেখানে গিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি তিনি একটি ইউটিউব চ্যানেলকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। তাতে তিনি কোথায় আছেন সেটা স্পষ্ট করেননি। পাশাপাশি ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারও পাশের দেশ ভারতে অবস্থান করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
জানা গেছে, পলাতক থাকা ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদের নামে ৩৮টি মামলা রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, খন্দকার নুরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান, সঞ্জিত কুমার রায় ও সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই হত্যা মামলা।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর ঢাকা মেইলকে বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেনি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
সম্প্রতি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, তারা এখন আর পুলিশ বাহিনীতে নেই, তারা এখন সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআইকে/জেবি

