কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে এগোলে কয়েক কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত অন্যতম পর্যটন স্পট হিমছড়ি। এখানে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ে। তবে প্রায় দুই যুগ আগেও এখানে তেমন কেউ আসত না। ছিল না সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাও। হিমছড়ির মেরিন ড্রাইভ ধরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল ঝাউবন, হ্যালিকপ্টার ওঠানামার হেলিপ্যাড ও মাঠ। ছিল বিভিন্ন প্রজেক্ট।
পাশেই ছিল চার থেকে পাঁচশ বাড়িঘরের গ্রাম। সেই গ্রামের নাম ছিল বাট্টু মিয়া হামার। এটি ছিল রামু ৯নং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। সেই গ্রামে হাজারখানেক মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু এখন কোনোটাই নেই। সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে সাগরে। সেই বাট্টু মিয়া হামারের নাম ও ইতিহাস জানে না অনেকেই। মানচিত্র থেকেও মুছে গেছে সেই গ্রামের নাম।
বিজ্ঞাপন
সেই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন আব্দুল হাই। পেশায় এখন তিনি সাগরপাড়ের ক্যামেরাম্যান। তার ঘরবাড়ি চলে গেছে সাগরে। তাই সরকারি জমিতে তারা এখন বসবাস করেন। সেই যুবক জানালেন একটি আস্ত গ্রাম সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়ার কাহিনি।
সাগর তখন কোথায় ছিল? বলতে তার ঝটপট উত্তর- আমাদের বাসা ছিল এখানে (হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন)। আমরা সেখানে হাল চাষ করতাম। তার কথায় এই প্রতিবেদক কিছু বিস্মিত হন। এরপর আবারও তাকে প্রশ্ন- সত্যি কি গ্রাম ছিল! তিনি বলতে থাকেন, এখানে তো এক সময় বাড়িঘর ছিল, গ্রাম ছিল। লোকজন থাকত। এই গ্রামের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে প্রায় দুই দেড় যুগ আগে।
তিনি বলছিলেন, এখানে (হাতের ইশারায় দেখাচ্ছিলেন) ধান চাষ হতো, মানুষজন বসবাস করত। আপনি যদি ২০০১ সালের ইতিহাস ও মানচিত্র ঘেটে দেখেন তাহলে বিষয়টি বুঝতে পারবেন। আগে ঝরণা ছিল কোথায়, এখন হিমছড়ির ঝরণা কোথায়! তাহলে তো আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না ঝরণার অবস্থান এখন কোথায়? গুগলে সার্স দিলে সেই চিত্র পাবেন।
৫০০ বাড়ির গ্রামটি সাগরে যাওয়ার নেপথ্যে
প্রায় ২০ বছর আগে ২০০৪ সালে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আঘাত হানে সুনামি। যার কারণে বদলে যায় বাট্টু মিয়া হামার নামের গ্রামটির মানচিত্র। সেই গ্রামের নাম এখনো সবার মুখে মুখে। কিন্তু বাস্তবে নেই। সেই বিধ্বংসী সুনামি বদলে দেয় সাগরের গতিপথ।
আব্দুল হাই হাত দিয়ে ইশারা করে বলছিলেন, ওই যে সাগরে নৌকাটা দেখছেন, সেখানে আমাদের বাড়ি ছিল। শুধু সুনানি নয়, প্রতি বর্ষায় আমাদের বাড়িঘর সাগরে গেছে। প্রতিবার আমরা নতুন করে ঘরবাড়ি বানিয়েছি। আবার ভেঙেছে। এভাবে ভাঙতে ভাঙতে আমরা আর থাকতে পারিনি। শেষমেষ এখন বন বিভাগের জায়গা আমতলী ছড়ায় বাড়ি করে বসবাস করছি। নয় ভাই, তিন বোন, মা-বাবা মিলে তাদের পরিবার বলে জানান এই যুবক।
তার মতে, আগে যখন সাগর পাড় ভাঙত তখন বালু ফেলা হতো তীরে। পরে এলো পাথর, সিমেন্টের তৈরি ব্লক। তবে এগুলো তখনও আবিষ্কার হয়নি। সেই সময় মেরিন ড্রাইভ রোডেও ভাঙন রোধে বালুর বস্তা ব্যবহার হতো। ভাঙতে ভাঙতে সাগর এখন পূর্ব দিকে এগিয়েছে। প্রতি বর্ষায় ভয়ংকর রূপ নেয় সাগর। মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যন্ত সাগরের পানি ওঠে।
আরও পড়ুন
এখনকার মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে সাগরের দিকে এগোতে থাকলে একসময় পা ব্যথা ধরে আসত। কিন্তু সেই বালুময় পথ এখন শুধুই সাগর।
সাগর এগোতে এগোতে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত একই অবস্থা। ফলে আগের চিত্র বদলে গেছে কক্সবাজার সৈকতের।
হিমছড়িতে বাট্টুমিয়া হামার নামে বড় একটি প্রজেক্ট ছিল। যা সাগরে চলে গেছে। পাশেই ছিল তাল সুপারি সাজানো আরেকটি গ্রাম। সেটির কিছু অংশ থাকলেও বাকিটা বিলীন হয়ে গেছে। হিমছড়ি মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে সোজা পশ্চিমে দুই কিলোমিটার রাস্তা ছিল। যা ধরে সাগর দেখতে যেত লোকজন। কিন্তু সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই এখন।
আব্দুল হাই বলছিলেন, বাট্টু মিয়া হামার নামের সেই গ্রামের লোকজন কক্সবাজার শহরে আসত ভাটা পড়লে। তাও সেটি চাঁন্দের গাড়িতে করে। ভাটা পড়লে গাড়িগুলো আসত হিমছড়িতে। আবার জোয়ার হলে থেকে যেত। আজ থেকে ২২ বছর আগে এদিকে কোনো যাতায়াতের সড়ক ছিল না। তখন মেরিন ড্রাইভ সড়ক হবে, এমন কথাও শোনা যায়নি।
একটি পুরো গ্রাম সাগরে বিলীন হওয়ার বিষয়টি যাচাই করতে কক্সবাজার শহরের প্রবীণ সাংবাদিক এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীনের সাথে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি এর সত্যতা নিশ্চিতই শুধু করেননি, তার কিছু স্মৃতিও তুলে ধরলেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
এই সাংবাদিক বলছিলেন, আমরা ইয়াং বয়সে কত গিয়েছি বাট্টুমিয়ার হামারে। সেখানে যেতাম পিকনিক করতে। যাওয়ার সড়কও তখন হয়নি। ফলে আমরা হেঁটে হেঁটে যেতাম। বাট্টু মিয়া হামার নামের এক ব্যক্তির নামে গড়ে ওঠেছিল গ্রামটি। সেই ব্যক্তি এখনো জীবিত আছেন। গ্রামটি মানচিত্রে আছে, তবে বাস্তবে নেই।
এমআইকে/জেবি