ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন হলেও পুলিশে এখনো তাদের দোসররা বহাল তবিয়তে আছেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সদর দফতরের বিশেষ মনিটরিং সেল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদের সেসব দোসররা পদায়ন পেয়ে এখনো বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার, ডিএমপির বড় বড় পদ, এসবি, সিআইডি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত আছেন। ফলে আওয়ামী লীগের আমলে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে আওয়ামী বিরোধী মনোভাবাপন্ন পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন, একতরফা ও মধ্যরাতের নির্বাচনে কাজ করা এবং তৎকালীন সময়ের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ২২তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা নাশিয়ান ওয়াজেদকে সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অতিরিক্ত ডিআইজি অপারেশনের দায়িত্ব থেকে বদলি করে পুলিশ স্টাফ কলেজে পদায়ন করা হয়েছে। বিষয়টিকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো মনে করছেন অনেকে।
বিজ্ঞাপন
নাশিয়ান ওয়াজেদ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হাবিবুর রহমানসহ মধ্যরাতের নির্বাচনের পরিকল্পনাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে এআইজি অপারেশন্সের দায়িত্বে থেকে সারাদেশে পুলিশ ইউনিটসমূহের সমন্বয়ের কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। ওই সময়ে ডিআইজি অপারেশন্সের দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার হোসেনকে ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল। তিনি ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচন আয়োজনসহ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির নয়াপল্টনের সমাবেশ ভণ্ডুলসহ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অবৈধ আদেশ সারাদেশে গোপনীয়ভাবে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া আস্থাভাজন গুটিকয়েক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত গোপন বৈঠকসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িতদের গ্রেফতার, হয়রানি, গায়েবি মামলা, বিভিন্ন নাশকতার গোপন ফাঁদ তৈরিসহ একতরফা নির্বাচন, মধ্যরাতের নির্বাচন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পুলিশি সিন্ডিকেটের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করেছেন। এসব কাজ করে পুলিশ সদর দফতরে পদায়নসহ নিয়মিত পদোন্নতি নিয়েছেন।
২০১৮ এবং ২০২৪ সালের মধ্যরাতের একতরফা নির্বাচনের সহযোগী হিসেবে কর্মরত পুলিশ সদর দফতরে ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু তাহের, ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম (যিনি বর্তমানে পুলিশ সুপার সাতক্ষীরা হিসেবে পদায়িত হয়েছে), ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা আব্দুলাহ আল মামুন (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিসহ বর্তমান মিশনে কর্মরত), ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইশরাত জাহান, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজা আক্তার, পিপিএম অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আবু হাসান, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও বর্তমানে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত মোশাররফ হোসেন, ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা এআইজি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা ফেরদৌসি রহমান, ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানাসহ (যিনি সম্প্রতি এডিসি ডিএমপি হিসেবে পদায়িত) অন্যান্য কর্মকর্তারা তৎকালীন শীর্ষ দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করেছেন।
পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় ও এলআইসি শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের প্রায় সব কর্মকর্তা গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলের বিরোধীদল দমনের গোপনীয় নির্দেশনা সমন্বয়, গ্রেফতার ও ধরপাকড়ের নির্দেশনা তৈরি ও বাস্তবায়ন, বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গোপন কল রেকর্ড আড়িপাতার কাজে জড়িত ছিলেন।
৫ আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর এসব কর্মকর্তাদের সবাই পুলিশের অত্যন্ত গোপনীয় ও সংবেদনশীল এলআইসি (ল ইন্টারসেপ্সন্স সেল) শাখায় কর্মরত থাকায় বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ছাত্রলীগের পদধারী ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাহবুবর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহমেদ, মোহাম্মদ হাসিনুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে সদর দফতরের ডেভেলপমেন্ট শাখায় কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় এখনো কর্মরত আছেন। সদর দফতরের বদলি ও পদায়ন শাখায় কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুবুল করিম- যিনি ২০১৮ সালে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পরবর্তী রাংক ব্যাজ পরিধান অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়ে আলোচিত হলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দ্রুত জাতীয়তাবাদী ঘরনায় নিজের নাম যুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ পদায়নে সম্পৃক্ত আছেন।
বিজ্ঞাপন
৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে যেসব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপাররা বদলি ও পদায়ন শাখায় শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হিসেবে পদায়িত ছিলেন তারা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও স্বপদে বহাল থাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হয়ে কাজ করা অনেকে এখনোও গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বহাল তবিয়তে কাজ করছেন।
৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে যেসব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপাররা বদলি ও পদায়ন শাখায় শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পদায়িত ছিলেন ওইসব কর্মকর্তারাই বর্তমানেও স্বপদেও বহাল থাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
গত ১৫ বছরে বিশেষ করে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনসহ পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি ড. শামসুন্নাহার, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ উল্লাহ, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ, বিরোধীদলের আন্দোলন দমন ও নিপীড়নের অন্যতম হোতা ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বহুল আলোচিত বিপ্লব কুমার সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন কর্মকর্তা ২৪ ব্যাচের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ এহসান সাত্তার, ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহফুজ রহমান আল মামুন, গত ১৫ বছরে পুলিশ সিন্ডিকেটের হোতাদের সহযোগী এবং নিজেকে প্রতিদিন শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাসহ গুটিবাজ কর্মকর্তাদের আদর্শের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতেন ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির, ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তা কাজী জিয়া উদ্দিন (যিনি সদ্য সাবেক সিইসির ভাই হিসেবে দাপটের সঙ্গে পরিচয় দিতেন, যিনি সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের পিএস, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের সময় এআইজি অপারেশন্সসহ গত ১৫ বছরে সব আইজিপিদের আস্থাভাজন হিসেবে কর্মরত থেকেছেন এবং বর্তমানে নিজেকে নানারকম বৈষম্যের শিকার দাবি করে পটপরিবর্তনের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেছেন), ৯১ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মুহাম্মদ তারিক (যিনি গত সরকারের সময় নিয়মিত পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পদায়িত ছিলেন), তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান, ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি ফারুক আহমেদ (যিনি ২০১৮ সালে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপারসহ পরবর্তীতে কুমিল্লার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তৎকালীন শীর্ষ পুলিশ সিন্ডিকেটের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত) ডিএমপির আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবং সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের সময়ে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পিআইও শাখায় কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ এহছান সাত্তারসহ চিহ্নিত কর্মকর্তারা এখনো সদর দফতরে গুরুত্বপূর্ণ শাখায় কর্মরত থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের সিন্ডিকেট পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এছাড়া ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় পদায়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সত্বেও বৈষম্যবিরোধী সময়ে সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ডিএমপিতে পদায়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দনা করে নিয়মিত ফেসবুকে পোস্ট দেয়া উপপুলিশ কমিশনার তাহমিনা তাকিয়া, আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক নরসিংদী ও যশোরের পুলিশ সুপার এবং সর্বশেষ পুলিশ সদরদফতরে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারের আস্থাভাজন তানিয়া সুলতানার পদায়ন নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থেকে চাঁদপুর, ফরিদপুর, জামালপুর, ফেনীসহ অন্তত ১৫ জেলার কর্মকর্তারা ঢাকায় এসবি, সিআইডি, টেলিকম, টুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশে পদায়িত হওয়া কর্তকর্তারা বর্তমান পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে সহানুভূতি পেয়েছেন বলে বঞ্চিত কর্মকর্তারা জানান।
পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপিসহ ঢাকাস্থ ইউনিটে কর্মরত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থীদের অনেকে ব্যক্তিগত ও ব্যাচভিত্তিক সুসম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ায় গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পুলিশি সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের সহযোগীরা ৫ আগস্ট পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী সময়ের সুবিধা ভাগিয়ে নিয়ে গোপনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের স্বাভাবিক কর্যক্রমের তথ্য ফাঁস ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
এমআর