দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ব্যস্ততা বাড়ছে নির্বাচন কমিশনের। এর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করেছে। ফলে ভোটের প্রস্তুতির মধ্যেও ইসির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রচার হওয়ায় সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন জেগেছে নির্বাচন কমিশনে ভেতরে ভেতরে হচ্ছেটা কী!
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেন। কমিশনে সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক সচিব এবং একজন নিম্ন আদালতের সাবেক বিচারককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে গণমাধ্যমের সামনে বেশি মুখোমুখি হন সাবেক ইসি সচিব মো. আলমগীর। এছাড়াও প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশন আহসান হাবিব খান, আনিসুর রহমান ও রাশেদা সুলতানাও মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে কথা বলছেন। তবে তুলনামূলক আনিসুর রহমান ও রাশেদা সুলতানা কম এসেছেন গণমাধ্যমে।
কখনো কখনো নির্বাচন কমিশনারদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হলেও সবশেষ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সিইসি ও আরেকজন কমিশনার পুরো উল্টো বক্তব্য দিয়েছেন। যা নিয়ে আলোচনা চলছে ইসির ভেতর-বাইরে। এই ঘটনার জেরে গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে মুখপাত্রও করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। যা নিয়েও সমালোচনায় পড়তে হয়েছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটিকে।
অবশ্য পরে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইসি সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারদের কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। অর্থাৎ তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন বলে স্পষ্ট করেছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
বিজ্ঞাপন
কয়েকদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার গণমাধ্যম সম্পাদকদের সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে যে চিঠি দিয়েছেন সেখান থেকে নির্বাচনের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়টি সামনে আসে।
সেখানে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য ‘প্রত্যাশিত পরিবেশ এখনো হয়ে উঠেনি।’ তবে অন্য একজন কমিশনার গণমাধ্যমে বলেছেন, 'ভোটের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে সিইসি অন্য কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করেনি।'
দুইজনের বক্তব্য কী সমন্বয়ের অভাবে ছিল এমন প্রশ্নের মুখে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব বলেছিলেন, 'একজন সম্মানিত নির্বাচন কমিশনার ওনার কথা বলেছেন। আমার কথা হচ্ছে তিনি সম্মানিত একজন ব্যক্তি। সমন্বয়হীনতা নেই। সমন্বয় অবশ্যই আছে।' কিন্তু সেই রেশ এখনো কাটেনি। ফলে দ্বন্দ্ব মেটাতে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবকে।
ইসি সচিবের যেন দম ফেলার সুযোগ নেই!
নির্বাচন কমিশনারের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পর দ্বন্দ্ব নিরসনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম গতকাল সোমবার (৬ নভেম্বর) দিনভর দৌড়ঝাঁপ করেছেন।
আরও পড়ুন
এমনকি মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া সচিব গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দুই আসনের উপনির্বাচনের ভোটের অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে পারেননি। মুখ খোলেননি কোনো কমিশনারও।
কর্মকর্তারা বলছেন, একজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের দ্বন্দ্ব নিরসনেই দৌড়ঝাঁপ করেছেন সচিব।
দিনভর যেভাবে ছুটেছেন ইসি সচিব
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথমে ইসি নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের দফতরে গিয়ে বৈঠক করেন সচিব। এরপর যান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খানের দফতরে। সঙ্গে নেন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার দুই যুগ্ম সচিব মো. ফরহাদ আহাম্মদ খান ও মো. আবদুল বাতেনকে।
এরপর সচিব আরেক কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানার দফতরে গিয়ে বৈঠক করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে যান নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের দফতরে। এরপর তিনি ফিরে আসেন নিজ দফতরে।
পরে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর কয়েক মিনিটের জন্য বৈঠক করেন মো. আহসান হাবিবের দফতরে। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের দফতরে তিন কমিশনার গেলেও নিজ দফতরেই অবস্থান করেন মো. আনিছুর রহমান।
ইসি সচিব ও কমিশনারদের এই দৌড়ঝাঁপের মধ্যে সাংবাদিকরা বারবার তাদের কাছে যান।
উপ-নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চাইলে সচিব মো. জাহাংগীর আলম ‘আজকে না’ বলে বারবার পাশ কাটিয়ে যান। এর মাঝেই সাংবাদিকদের চোখ এড়িয়ে দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে দ্রুত নির্বাচন ভবন ত্যাগ করেন সিইসি। পরে সচিবসহ একে একে অন্য কমিশনাররাও চলে যান।
কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণে অনেকটা একলা চলো নীতিতে অবস্থান নেন। তাই সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে দ্বন্দ্ব নিরসনেই চলে দিনভর খণ্ড খণ্ড বৈঠক। মূলত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে চলছে এই দ্বন্দ্ব।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে চান। আর ভোটগ্রহণ শেষ করতে চান জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে।
বিইউ/এমআর