রহমত উল্লাহ ও ঝর্ণা বেগমের সংসার জীবন সাড়ে চার বছরের। এরমধ্যে ঘর আলো করে এসেছে ছেলে লাবণ্য। গত দেড় বছর থাকছেন আজিমপুর ইরাকি মাঠ সংলগ্ন দুই রুমের ভাড়া বাসায়। এবার তারা নতুন ‘সাবলেট’ বাসা খুঁজছেন। বেসরকারি চাকুরে রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না, তাই বাসাটা ছেড়ে দিয়েছি। একটা সাবলেট খুঁজছি। পকেটের অবস্থা, বাজারের ঊর্ধ্বগতি, সেই সাথে সংসারের খরচ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বউ ছোটখাটো একটা চাকরি করত, বাবু আসার পরে ছাড়তে হয়েছে।’
রহমত বলেন, ‘মাসে বেতন পাই ২৫ হাজার টাকা। দুই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া ছিল সব মিলিয়ে ১৫ হাজার। এরমধ্যে চলতি বছরের শুরুতে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়েছে। অন্যদিকে গত দুই বছরেও বেতন বাড়েনি। প্রথমে চিন্তা করেছিলাম স্ত্রী-সন্তান গ্রামে পাঠিয়ে দেব। হিসাব করে দেখলাম, তখন খরচ আর ভোগান্তি দুটোই বাড়বে।’
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: বেপরোয়া ‘সিন্ডিকেট’, অসহায় ভোক্তা
ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘একটা সুপার শপে চাকরি করতাম। সেখানে পেতাম ১০ হাজার টাকা। দুজনের আয় দিয়ে মোটামুটি চলছিল। মাস শেষে শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যও কিছু টাকা দেওয়া যেন। বর্তমানে এমন অবস্থা- ঘর ভাড়া আর বাজার খরচ শেষে মাসের শেষ ১০ দিন চলতে হয় ধারকর্জ করে।’
নগরীর অন্তত ১০টি স্থান ঘুরে দেখা যায়, মাসশেষে টু-লেট বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বেড়েছে সাবলেট প্রত্যাশীদের আবেদন। কেউ বাসা ছেড়ে সাবলেট ভাড়া দিচ্ছেন, কেউবা নিজেকে গুটিয়ে বাসার একটি রুম সাবলেট হিসেবে দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
লালবাগ বড় ভাট মসজিদ সংলগ্ন এলাকার তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে থাকেন ফাহিম ফয়সাল। তার সাথে সাবলেট ভাড়া হবে- এমন বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের (দেয়ালে) সময় কথা হয় প্রতিবেদকের। সাবলেট প্রত্যাশী পরিচয়ে ফাহিমের সাথে বাসা দেখতে যান প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে থেকে রান্নাঘর কোথাও তিল ধরার জায়গা নেই। সাবলেট হিসেবে নির্ধারণ করা রুমটিতে রয়েছে এটাচ বাথরুম, বারান্দা। অন্য দুই রুমের জন্য পাকঘর লাগোয়া টয়লেট। ঘরে তার বৃদ্ধ বাবা-মাসহ পাঁচজন থাকেন।
আরও পড়ুন: কাটছাঁট করেও সংসার চালানো দায়!
ভাড়া নিয়ে আলাপকালের একপর্যায়ে ফাহিম ফয়সাল বলেন, ‘এটাচ বাথরুম ছাড়া বেশি টাকায় সাবলেট ভাড়া দেওয়া যায় না। অন্যদিকে পরিবারে খরচ বেড়েছে। বিদ্যুৎ থেকে পানি বিল সবই বেড়েছে। সবগুলো রুমই প্রয়োজন পরিবারের, তাও নিজেদের গুটিয়ে সাবলেট ভাড়া দিতে হচ্ছে।’
নগরীর অন্তত ১০টি স্থান ঘুরে দেখা যায়, মাসশেষে টু-লেট বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বেড়েছে সাবলেট প্রত্যাশীদের আবেদন। কেউ বাসা ছেড়ে সাবলেট ভাড়া দিচ্ছেন, কেউবা নিজেকে গুটিয়ে বাসার একটি রুম সাবলেট হিসেবে দিচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান মূল্যস্ফীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। তার চেয়েও বেশি চাপে দিন পার করছে মধ্য আয়ের মানুষ। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজারের লাগাম টানা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।
আরও পড়ুন: ‘চলা খুব কঠিন হয়ে গেছে’
বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের সংসার। মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে কখনো সঞ্চয় ভেঙে কখনো আবার ধারদেনা করেই চালাতে হয় সংসার। শখ করে একটা কিছু কেনা, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। মেহমান এলে যতটা খুশি হন তার চেয়ে যথার্থ আপ্যায়ন করতে না পেরে খারাপ লাগে।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আলাপকালে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বেতন পাই মাসে ৩০ হাজার টাকা। অফিস পল্টন হলেও কম টাকায় বাসা পাওয়া যাবে বলে এখানে থাকা। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানো বড়ই কঠিন হয়ে গেছে। বেতন পাওয়ার প্রথম ১০ দিনে মধ্যে হাত খালি হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো চলতে হয় কষ্ট করে। গ্রামে বাবা-মাকে নিয়মিত টাকা পাঠানোরও অবস্থা থাকে না। বাসা ভাড়াতেই সব শেষ। তার মধ্যে আছে বছর শেষে ভাড়া বাড়ার চিন্তা।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান মূল্যস্ফীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। তার চেয়েও বেশি চাপে দিন পার করছে মধ্য আয়ের মানুষ। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজারের লাগাম টানা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আয়ও বেড়েছে। কিন্তু যে হিসেবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সে হিসেবে মানুষের আয় বাড়েনি। এর জন্য মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আছেন তাদের চলা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় বাড়লেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
আরও পড়ুন: ব্যয়ে হিসাবি হচ্ছে উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও
সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একটু স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে চাইলে ৫০ হাজার টাকার উপরে মাসিক ইনকাম করতে হবে। আর আমাদের দেশের যেই জিনিসটার দাম একবার বাড়ে সেটা কমার ইতিহাস নাই। এজন্য মানুষ কষ্টে দিন যাপন করছে।’
ডিএইচডি/জেবি