রাজধানীর পল্লবীর কসাই খলিল (৬০)। এক সময় গরুর গোশতের ব্যবসা করতেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন পল্লবীবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। চাঁদাবাজি, অন্যের জমি দখল, হত্যার উদ্দেশে মারপিট, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। খলিল ও তার বাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্যাতিত পরিবারের অনেকে থানায় মামলা করেও আপস করতে বাধ্য হয়েছেন।
সম্প্রতি পল্লবী থানা এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
কে এই কসাই খলিল?
কসাই খলিল নিজেকে বড় নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। পল্লবী থানা যুবলীগের কমিটিতে আছেন বলে দাবি করেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার ভয়ে তটস্থ পল্লবীবাসী।
আরও পড়ুন: ‘২ লাখ টাকার লাইগা কলিজাডা কাইরা নিল এসআই জহিররা’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খলিল থাকেন পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় ১১ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ৬ নম্বর বাসায়। তার বাবার নাম মজিবর রহমান। তার মা এক সময় অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন।
বিজ্ঞাপন
পল্লবীতে ‘খলিল বাহিনী’ আতঙ্ক
এলাকাবাসী জানিয়েছে, এমন কোনো কাজ নেই যা খলিল ও তার বাহিনীর সদস্যরা করেন না। পল্লবী এলাকায় কেউ নতুন জমি কিনলে, জমিতে মাটি ভরাট করার প্রস্তুতি নিলে, ভবন নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করলে তার বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে হাজির হন। মোটা অংকের চাঁদা না দিলে কোনোভাবে কাজ করতে দেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে থানায় মামলা করলে তাদের ওপর খসাই খলিলের লোকজন হামলা করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই বাহিনীতে তার ভাই কসাই সাদ্দাম (৩২), জাহিদ (৪০), অলি হোসেন তেইল্যা (৩৫), ইয়াবা নাদিম (২৫), রাকিব (২০), ছিনতাইকারী রেজাউল (২২), দলু (৪৫), রফিক ও জব্বার ছাড়াও ২০ জনের মতো যুবক রয়েছে বলে জানা গেছে। তারা পুরো পল্লবী এলাকা দাপিয়ে বেড়ান।
খলিলের সহযোগী হিসেবে তার ভাই কসাই সাদ্দাম কাজ করেন। মূলত সাদ্দাম খলিলের ডান হাত। ভাইকে দিয়েই অন্যের জমি দখল, চাঁদাবাজির কাজ করে থাকেন খলিল। এক সময় তার কোনো কিছু না থাকলেও এখন ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমি অনেক কিছু হয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, তিনি শত কোটি টাকার মালিক।
চাঁদা না দিলেই হামলা
গত ১ জুলাই বাউনিয়া এলাকার কালশী রোডে মাটি ভরাটের কাজ চলছিল। সেখানে গিয়ে হাজির হন খলিলের লোকজন। তারা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সেখানেই মারধর করা হয় অন্তর নামে এক যুবককে। তাকে এতটাই মারধর করা হয় যে, অন্তরের মাথায় ৫০টির বেশি সেলাই দিতে হয়। পরে এ ঘটনায় অন্তরের বোন রাবেয়া বেগম পল্লবী থানায় মামলা করলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। উল্টো তারা জামিনে বেরিয়ে হুমকি দিতে থাকে। বাধ্য হয়ে সম্প্রতি সেই মামলায় আপস করেছে পরিবারটি।
আরও পড়ুন: ‘প্রকাশ্যে মাইরা ফেললো, তাগোরে কেমনে জামিন দেয়?’
মামলার বাদী রাবেয়া বেগম ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, ‘ভাই! আমাদের তো বাঁচতে হবে। এ কথা ভেবেই মীমাংসা করছি। তাছাড়া আমার ভাইটার তো ভবিষ্যৎ আছে।’

ভুক্তভোগী পবিরারটির অন্য সদস্যরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘খলিল খুবই খারাপ মানুষ। তার সাথে এলাকার কেউ পেরে উঠতে পারে না। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেই তার ওপর হামলা করে বসে খলিলের লোকজন।’
শুধু অন্তরই নয়, তাকে মারধরের সময় অনিক নামে এক যুবক তা দেখে ফেলায় তাকেও সপ্তাহখানেক আগে মারধর করা হয়। অনিক থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু থানা পুলিশ সেই মামলা নেয়নি।
এ বিষয়ে পল্লবী থানার ওসি মাহফুজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, মামলাটি আপস হয়েছে। পরিবারটি নিজ ইচ্ছায় নাকি মীমাংসা করেছে খলিলের সাথে।
আরেক ভুক্তভোগী আমির মোল্লা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি মাটি ভরাটের কাজ করছিলাম। খলিলের লোকজন এসে চাঁদা চেয়েছিল। দিইনি বলে আমাকে তারা মারধর করে। পরে এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেছিলাম, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
খালি জমি দেখলেই খলিলের চোখ পড়ে
পল্লবীতে অনেকের মুখে মুখে একটা কথা ঘুরেফিরে শোনা গেল- কোনো জমি ফাঁকা থাকলে তাতে খলিলের চোখ পড়বেই। তাদের এসব কথার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: ‘সিম কিনে’ যেভাবে ফাঁসলেন পুরো গ্রামের বাসিন্দারা
জাওয়াদ আল শরীফ নামে এক ব্যক্তি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘টাকায় কেনা আমার জমি। কিন্তু খলিল বলে এই জমি নাকি তার। এই বলে সে গত এক বছরে কয়েক বার দখলের চেষ্টা করেছে। এসব ঘটনায় তিনবার থানায় জিডিও করেছি। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরে না। এভাবে আর কতদিন। সে আমার বাবাকে কল করে বলে- আমি মাটি ভরাট করছি। হয় জমি বিক্রি করবেন না হয় আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকায় কিনে নেবেন। আমার সাইনবোর্ড আছে, কাগজ আছে। কিন্তু সে অন্য লোকদের মালিক বানিয়ে দখলের চেষ্টা করছে।’
তিনি অভিযোগে আরও বলেন, ‘কসাই খলিলের এক সময় কিছুই ছিল না। কিন্তু আজ সে শত কোটি টাকার মালিক। এত টাকা পেল কোথায় থেকে? অন্যের জমি দেখলেই সে তার লোকজন নিয়ে ছুটে যায়। রাতের আঁধারে জমি দখল করে।’
জাওয়াদ জানান, শনিবার ভোররাত থেকে তার জমি ব্যবহার করে ট্রাক দিয়ে পাশের জমিতে মাটি ভরাট করছে খলিল ও তার লোকজন। মূলত তার জমি দখলের চেষ্টার অংশ হিসেবেই এটা করা হচ্ছে। বিষয়টি থানায় জানালেও পুলিশ আমলে নেয়নি। উল্টো বলে অভিযোগ দিয়ে যান। এ ঘটনায় জাওয়াদ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নিজের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের বিষয়ে কসাই খলিল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমার প্রতিপক্ষরা এসব করছে। আর জাওয়াদ নামে আমি কাউকে চিনিও না। জমি যদি তার হয়ে থাকে তাকে কাগজ নিয়ে আসতে বলেন। আমি তার জমি কেন দখল করব। তার জমির মালিকতো চারজন। তারাই আমাকে অভিযোগ করেছে।’ চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে খলিল এই প্রতিবেদককে মামলার ভয় দেখান এবং রাগান্বিত হয়ে কল কেটে দেন।
খলিলের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ করেছেন মিন্টু নামে আরেক ভুক্তভোগীও। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, ২০০৯ সালে একটি আড়াই কাঠার জমি কিনেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে জোর করে জাল দলিলে কসাই খলিল তার লোকজন দিয়ে জমিটি দখল করে নেন। এখন সেটিতে এক তলা একটি ভবন তুলেছেন খলিল। মিন্টু সেই সময় একাধিকবার থানায় জিডিও করেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি জমি ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মিন্টু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেকখানে দৌড়ালাম। কিন্তু কোনো কাজ তো হলো না। খলিলের অনেক টাকা। আমরা তার কালো টাকার কাছে হেরে গেছি।’
কসাই খলিলে ফাঁসি চেয়ে পোস্টারিং!
পল্লবীবাসী কসাই খলিলের অত্যাচারে এতটাই অতিষ্ঠ যে, তারা তার ফাঁসি চেয়ে পোস্টারিং করেছেন। সেই পোস্টারের ছবি এসেছে ঢাকা মেইলের কাছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, খলিলের গাায়ে সাদা পাঞ্জাবি। হাতে তলোয়ার আর মাথায় কালো টুপি। গলায় ফাঁসির দড়ি। তাতে লেখা ‘ফাঁসি চাই’।
আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় পুলিশ, তালিকায় হাজার নাম
খলিলের ফাঁসি চেয়ে এই পোস্টারিং করেছে পল্লবী থানা যুবলীগ। সেই পোস্টারে কসাই খলিলকে খুনি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পোস্টারের চারপাশে বিভিন্নজনকে নির্যাতনের সময়ে তোলা ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে।

অন্য আরেকটি পোস্টারে পল্লবীর বাউনিয়া এলাকার মোছা. লিপি নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যার অভিযোগে তার ফাঁসি চেয়েছে পল্লবীবাসী। পোস্টারে লেখা হয়েছে, ছয় মাসের গর্ভবতী লিপি যাদের হাতে জীবন দিলো তাদের নিঃশর্ত ফাঁসি চাই। সেই সাথে মা ও শিশুকে হত্যাকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী খলিল ও তার সহযোগী কালা আজিজের ফাঁসি চাই। তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল সেই সময়। আজ থেকে সাত আট বছর আগে লিপিকে হত্যার অভিযোগ ওঠে কসাই খলিলের বিরুদ্ধে। তবে সেই পরিবারটি এখন ভয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলে না। তারা জীবনের ভয়ে কসাই খলিলে সঙ্গে আপস করেছেন বলে জানা গেছে।
যা বলছে প্রশাসন
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লাকে ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে কল করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি পল্লবী থানার ওসির সাথে কথা বলেন।
পরে পল্লবী থানার ওসি মাহফুজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার থানায় খলিলের নামে দুটি মামলা রয়েছে। মারপিট ও চাঁদাবাজি। জাওয়াদ শরীফ নামে একজনের জমি দখলের চেষ্টা করছেন খলিল- এমন অভিযোগ তুলে সেই ব্যক্তি তিনবার জিডি করেছেন। আবারও তাকে অভিযোগ দিতে বলেছি। লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমরা কিছু করতে পারি না। তাছাড়া খলিল জামিনে আছেন, এ কারণে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে পারি না। খলিলের ব্যাপারে এই প্রথম আপনার মুখে এত কিছু শুনলাম। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দিতে বলেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এমআইকে/জেবি

