শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘২ লাখ টাকার লাইগা কলিজাডা কাইরা নিল এসআই জহিররা’

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২৩, ১১:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

‘২ লাখ টাকার লাইগা কলিজাডা কাইরা নিল এসআই জহিররা’
লাভলী আক্তার। ছবি: ঢাকা মেইল

‘ওরা আমার মেয়েরে মেরে ফেলছে। আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। পুলিশের এসআই জহির তাকে মারধর না করলে আমার মেয়ের কিছু হতো না। ওরা আমার কলিজাটারে কেড়ে নিল।’

মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) বিকেলে মিরপুরের কালশী এলাকার আদর্শ নগর মহল্লার নিজ বাসার সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন ‘পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানকালে’ আত্মহত্যা করা তরুণী বৈশাখীর মা লাভলী আক্তার।


বিজ্ঞাপন


আদরের প্রিয় সন্তান বৈশাখী এখন পরপারের বাসিন্দা। আজ রাতেই বৈশাখীর দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। বিকেলে মেয়ের জন্য যখন মায়ের এমন আহাজারি তখন লাভলী আক্তারকে ঘিরে ভিড় করছিলেন উৎসুক জনতা। সকলের মুখে একটিমাত্র কথা- মায়ের শাস্তি মেয়ে পাবে কেন? মা তো বছরখানেক আগেই মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।

গতকাল সোমবার (২৪ জুলাই) রাতে পল্লবী থানার আদর্শনগর এলাকায় পুলিশের ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ চলাকালে লাভলী আক্তারের বাসা থেকে তার মেয়ে বৈশাখীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে লাভলী আক্তারের সঙ্গে কথা হলে ঢাকা মেইলকে তিনি পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান।Pollobiসোমবারের বিকেলটা তাদের মা-মেয়ের ভালোই কাটছিল। মা মাদক কারবারি হলেও মেয়ে বৈশাখী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা অপরাধমূলক এই পেশার ধারের কাছেও নেই। সোমবারের ঘটনা জানিয়ে লাভলী ঢাকা মেইলকে বলেন, বিকেলে হঠাৎ পুলিশের দুই সোর্স এসে আমাকে বলতে থাকেন- পল্লবী থানার এসআই জহির ও ফেরদৌস আমার বাসার দুইপাশে অবস্থান করছে। আমাকে আজ ধরে থানায় নিয়ে যাবেন তারা। এর কিছুক্ষণ পর জহিরের সঙ্গে আমার তর্ক বাঁধে।

লাভলী আক্তারের ভাষ্য- তিনি প্রতি মাসে থানাকে ম্যানেজ করাতে ৩০ হাজার করে টাকা দেন। রোববার (২৩ জুলাই) এসআই জহির তার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। কিন্তু সোমবার এসে যখন তাকে আবারও গ্রেফতারের ভয় দেখানো হয়, তখন এসআই জহিরের সঙ্গে তার তর্ক বাঁধে। ওই সময় এসআই জহির তার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে সেই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়ে বৈশাখী আক্তারের সামনে তাকে বেধড়ক পেটানো হয়।

লাভলী আক্তারের দাবি- পুলিশের মারধরে তার কাপড় ছিঁড়ে যায় এবং তিনি অর্ধউলঙ্গ হয়ে যান। ওই অবস্থায় তার কাছে থাকা ৭০ হাজার টাকা এসআই জহির ও ফেরদৌস ছিনিয়ে নেন। এরপর তাকে হেরোইনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে নারী পুলিশ দিয়ে জোর করে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে পালিয়ে যেত সক্ষম হন লাভলী। এরপর বাসা থেকে বের হয়ে পাশে থাকা নিজ ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু মেয়ে বৈশাখী তৃতীয় তলায় আটকা পড়েন। এরপর কি ঘটেছে জানতেন না। পরে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর জানতে লাভলী পারেন তার মেয়ে বৈশাখী আত্মহত্যা করেছে।Pollobiএদিকে, ঘটনার পর সোমবার রাতে পুলিশের পাঁচ সদস্য ছাড়াও তিন সোর্সকে আটক করেন এলাকাবাসীরা। এ নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায় ওই এলাকায়। পরে রাত সাড়ে ১২টায় মিরপুর জোনের এডিসি পুলিশ সদস্যদের দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে মারধর করে জোর করে সেই বাসায় প্রবেশ করেন এবং আটককৃত পুলিশ সদস্যদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তবে সেদিন থেকেই পুলিশের কাছে আটক ছিলেন লাভলী। আজ মঙ্গলবার বিকেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।


বিজ্ঞাপন


লাভলী আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি এই হত্যার বিচার চাই। আমার মেয়ের আত্মহত্যার পেছনে দারোগা জহির ও ফেরদৌস দায়ী। আমি তাগোর (তাদের) বিচার চাই।

পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লাভলী আক্তার বলেন, পুলিশ সদস্য এসআই জহির যখন তাকে গ্রেফতারের হুমকি দিতে থাকেন, তখন তার মেয়ে বৈশাখী বলে- ‘মা’র কাছে ঠিকই তো টাকা নেন। লোভ পাইয়া গ্যাছেন গা। আশপাশে অনেকে এ ব্যবসা করে তাগোরে (তাদের) ধরেন।’ বৈশাখীর এই কথা শেষ না হতেই এসআই জহির তার মেয়েকে মারধর করা শুরু করেন। তাকে ওই সময় চড়-থাপ্পড় মারা হয়। তখন লাভলী বলতে থাকেন- ‘আপনি আমারে মারেন, আমার মেয়েরে মারেন ক্যা। আমার মেয়ে তো দোষ করে নাই। আর আপনি তো আমগোর (আমাদের) কাছ থাইক্যা কিছু পান নাই।’

পরে এসআই জহির তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি টাকা দাও।’ পরবর্তীতে এসআই জহিরের এমন কথা শুনে বাসার নিচে নেমে যান লাভলী। এরপর বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিয়ে এবং নিজের সঙ্গে থাকা মিলিয়ে মোট ৭০ হাজার টাকা ম্যানেজ করে এসআই জহিরকে দেন। তবে সেই টাকা নিয়েও লাভলীকে থানায় নিয়ে যেতে চান পুলিশ সদস্যরা। ওই সময় তার মেয়ে বৈশাখী বলে ওঠে- ‘আপনি আমগোরে (আমাদের) মারলেন আবার থানাতেও নিয়া যাইতে চান।’Pollobiপরে এসআই জহির বৈশাখীকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন- ‘তুই ঘরে গিয়া ফাঁসি দিয়া মর গা, তারপরও তোর মায়েরে নিয়া যামু।’ এরপর লাভলীকে ধরার জন্য মহিলা পুলিশ সদস্যরা আসেন। পরে ধস্তাধস্তিতে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

লাভলীর দাবি- বর্তমানে তিনি মাদকের কারবার করেন না। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘হেই ব্যবসা করি না বইলাই তো গতকাইল আমারে ধরবার আসছিল। তারা আইসা আমার কাছে টাকা চায়। এসআই জহির ও ফেরদৌস দারোগা আমার কাছ থাইক্যা ২ লাখ টাকা চাইছিল। দিবার পারি নাই। তয় ঘরে কিছু টাকা আছিল, আর পাশের থাইক্যা আইনা ৭০ হাজার টাকা দিছি, তারা জোর কইরা নিয়া গ্যাছে।’

কাদের কাছ থেকে মাদক পেতেন এমন প্রশ্নে ঢাকা মেইলকে লাভলী বলেন, ‘দারোগা জহির, ফেরদৌস ও পুলিশের সোর্স দুই ওয়াহিদ আমারে দিয়া যাইতো। এখন ব্যবসা করি না বলেই তো কাইল (কাল) এই অবস্থা করছে। তাগোরে মাসে ৩০ হাজার টাকা দেই। এই টাকা জহির ও ফেরদৌস দারোগায় নেয়। পরশু দিনকা ৭০ হাজার দিছি। তার আগের ৫০ হাজার দিছি। হের আগের দিন ৩০ হাজার দিছি। তারা গত চাইর-পাঁচ দিন থাইক্যা টাকা নিয়া যাইতাছে। তারা আমার থাইক্যা দুই তিন বছর হইলো টাকা নেয়।’

এদিকে, লাভলীর ভাই সুজনের ভাষ্য- ‘আড়াই ঘণ্টা পর তারা আমার ভাগনির লাশ নামাইলো। আমার বোন অপরাধ করতে পারে, কিন্তু সে (বৈশাখী) তো অপরাধ করে নাই। তাইলে তারা আমার ভাগনিরে শাস্তি দিলো কেন?’Pollobiঅন্যদিকে লাভলীর প্রতিবেশীদের অভিযোগ- এসআই দারোগা ও এসআই ফেরদৌস প্রতি মাসে এসে লাভলীর কাছে মাসোহারা (টাকা) নিয়ে যান। এসআই জহির মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি এলাকায় লাভলীকে দিয়ে মাদকের ব্যবসা করাতেন। এর আগে লাভলীকে ধরতে এসে ঘরের দরজায় ধাক্কা ও চাপ দিলে লাভলীর বাবার হাতের চারটি আঙ্গুল কেটে যায়। পরে সেই যন্ত্রণা ভুগে কিছুদিন পরই মারা যান তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে এসআই জহিরকে কল করা হলে তিনি সব বিষয় শুনে বলেন, ‘আমি আপনাকে দুই মিনিট পর কল করছি।’ এরপর তাকে কল করা হলেও আর ফোনে পাওয়া যায়নি। একইভাবে এসআই ফেরদৌসকে কল করা হয়। পরে কল রিসিভ না করায় তাকে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। তবে এর কোনো উত্তর দেননি তিনি।

পরবর্তীকালে এসব বিষয়ে জানতে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লাকেও একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনিও কোনো ফোন রিসিভ করেননি।

অবশ্য বিকেলে পল্লবীর কালশী মোড়ে দেখা হলে পল্লবী থানার অপারেশন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। পরে জহির ও ফেরদৌসের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে কথা বলা নিষেধ। যা বলার ডিসি স্যার বলবেন।

এমআইকে/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর