শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যদি আর একবার পেতাম মাকে, আর একটিবার! 

রাতুল খন্দকার
প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

যদি আর একবার পেতাম মাকে, আর একটিবার! 

আজ থেকে তের বছর আগে মা আমার থেকে সশরীরে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনে আসন গেড়ে বসে আছে আজন্ম, ছুঁতে না পারার অস্থিরতাটুকু পোড়ায় শুধু। ডিসেম্বরের এসময়টা কেমন বিবর্ণ। আমার মতো শোকে প্রকৃতিও রুক্ষ্ণ। পাতা ঝরার মিছিলে চারপাশ ছোপছোপ শোকে স্তব্ধ। এ আমার বুকে পাথর বয়ে বেড়াবার দিনের আরম্ভ। 

একটা পুরো জীবন কাটল দারুণ শোকে। আমার আঠারো বছর বয়স, আর মার একচল্লিশ বছর বয়স, তারপর আলাদা পৃথিবী। এই শোক কী দিয়ে ভোলা যায়? ভোলা যায় না আদতে, ভুলতে চাই না। মাকে বুকে নিয়েই, আঠারো বছরের স্মৃতি নিংড়েই একটা জীবন বাঁচা যায় বৈকি, বেঁচে আছি তো। 


বিজ্ঞাপন


২০০৯ এর এই সময়টায় মা কেমোথেরাপির সাথে দুইবছর যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছিল। কেমোথেরাপি দেবার পর মার চুলগুলো ঝরে যাচ্ছিল সব। মা ফোন করে বলল, ‘চুল ছাড়া কেমন দেখাবে বলতো?’ আমি  বললাম, ‘মা, আবার নতুন চুল উঠবে। চিন্তা করো না তো।’ নতুন চুল উঠল, আরও ঘন হলো আগের চেয়ে। আমি মাকে বুকের মধ্যে করে করে রাখলাম, মা ন্যাওটা আমার পুরো পৃথিবীই তো মা। মাকে ঘিরেই সবকিছু। মারও সংসারের, চাকরির সব গল্প আমাকে বলতেই আনন্দ অপার। দুজন-দুজনার পরম আশ্রয়। 

man

বাবাও মাকে ভালোবেসে ঘরে এনেছিল। বাবার কষ্টটা গোপন রাখলেও বুঝি মানুষটা ভিতরে ভিতরে কতটা নদী বহন করে, আর ভাইয়ারও সুখের সময়ে মা নাই, আমাদের তিনজনার একটাই প্রাণ ছিল তো। আঠারো বছরের আগে থেকেই আমি মান্নাদের গানের ভক্ত হয়েছিলাম, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত হয়েছিলাম। সুতরাং ভালোবাসার গভীরতার ওম বুঝি খুব কম বয়স থেকেই আমি পেয়েছিলাম বুকের ভেতর। সেটাও মার কাছ থেকেই পাওয়া তীব্র মায়া, তীব্র ভালোবাসার শক্তি। তাই সেই বয়সেই মার সাথে আমার অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর সব স্মৃতি। 

মা একটা পুতুল ছিল আমার কাছে, ক্লাস সেভেনের পর মার শাড়ি আর সব আমিই কিনতাম। মার মেয়ে না থাকায় গলায় হার পরাতাম, মুখে পমেড মাখিয়ে দিতাম, শাড়ির কুচি ধরতাম, পায়ে স্যানডেল পরিয়ে দিতাম, আদর দিয়ে দিয়ে সাজাতাম আমার দারুণ মায়াবতী পুতুলটাকে। কী সুন্দর মুখটা, কি সুন্দর! এত মায়া আর কারো মুখে থাকে না কেন? ঐ কণ্ঠটার মতো আত্মা শীতল হওয়া আর কোনো একটা গলা নেই কেন? বড় হয়েও কেন মা থাকবে না! এখন তো আরও মায়ার ওম বেড়েছে আমার, এখন কেন মাকে আদর করতে পারব না, মাঝে কেন তবে বিশাল পাহাড়? 


বিজ্ঞাপন


নভেম্বরের ২৮ তারিখ কোরবানির ঈদ ছিল। মা হাঁটতে পারছিল না আর, কোলে করে বাবা, আমি, ভাইয়া এবং বাড়ির সবাই বাথরুম, বারান্দা, ঘরে আনা-নেওয়া করছিলাম। সকালবেলা বারান্দায় চৌকিতে আমি বিছানা রেডি করে নিয়ে যাই, মার শিয়রে বসে থাকি সারাদিন। চোখগুলি দেখি কী অপূর্ব  সুন্দর, গা থেকে ভেসে আসে বেহেশতী সুবাস। আমি নাক ডুবিয়ে রাখি, বড়মা ভাবেন আমি কাঁদছি বুঝি। আমি কাঁদতাম না, আমি মার গায়ের ঘ্রাণ নিতাম, কী অপূর্ব  ঘ্রাণ!

mother

দিনে হাজার হাজার মানুষ এসে দেখে যান তাদের প্রিয় মুখটাকে। মায়াময় মানুষটাকে, তাদের প্রিয় সবুজছাতা আপাকে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন আগেই মার সময় শেষ, ক্যানসারটা পুরো লিভারে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাকে সে কথা মা চলে যাবার দুইদিন আগে জানালো ছোটখালু। কাঁদলাম না, মধ্যরাতে আঙিনায় গিয়ে বসে শুধু ভাবলাম মাকে ছাড়া এই বিশাল বাড়িতে কীভাবে থাকবো আমি? এ পৃথিবীতে আমি বাঁচবো কীভাবে, কী অর্থহীন হবে জীবন আমার, সুইসাইড পাপ কেন। আমার পৃথিবীই তো মা। কিন্তু আমি এর শেষ দেখব। 

দুই ফুপু আমার পাশে গিয়ে বসেন মাঝরাতে আঙিনায়। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, ঘরে মার কাছে আনেন। ডিসেম্বরের সাত তারিখ ভোরবেলা মার মুখে শরবত দিয়ে মার মাথায় হাত নাড়ছিলাম। বড়মা বলল, ‘টুটুল কই, টুটুলের বাবা কই, ওরা যদি শেষবারের মতো জান্নাতকে দেখে আসতে বলো।’ আমি মার মাথার কাছ থেকে নেমে মুখের সামনে এসে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ডাকলাম মাকে, মা আর সাড়া দিল না। এই মুহূর্তটা আমি এই তের বছরে একদিনের জন্যও ভুলিনি। 

>> আরও পড়ুন: মা-ছেলের যে দৃশ্যে আবেগে ভাসল পুরো বিশ্ব

আমাকে আট দশজন মানুষ চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে রাখল, আমার গলার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছিল, কাঁদতে পেরেছিলাম, আমি চিল্লাতে পেরেছিলাম, বলে বোধহয় বাঁচতে পেরেছিলাম পরে আরও একজীবন মা ছাড়া। মা চলে গেলো আমাকে রেখে, সারাজীবনের জন্য। আর মাকে মা বলে ডাকতে পারবো না, আদর করতে পারবো না, আমার আত্মা শীতল হবে না কখনো, এমন জীবন বহন করা আমার জন্য কতটা কঠিন আমি জানলাম। আমি বুঝলাম মাকে বুকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটানো পথগুলি কেমন। 

man

ভাইয়া ব্যাংকার হলো, আমি ফার্মাসিস্ট হলাম। নিজের টাকায় মাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারলাম না একজীবনে। মা দুই বৌমাকে, পূর্ণতা, স্বচ্ছতা, মুগ্ধতাকে দেখলো না, আদর করলো না। বুড়ো হলো না, চামড়ায় ভাজ পড়লো না, আমাদের অনাগত আসতেছে মা কোনদিন দেখবে না, এ কেমন জীবন আমাকে বইতে হচ্ছে তা আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না কোনদিন। কারণ ঐ যে মা ন্যাওটা ছেলে আমি মার। 

তবে ভালোলাগার বিষয় হচ্ছে মাকে কেও ভুলল না, সবার সঙ্গে মিশতে পারা, প্রচন্ডরকমের ভালো মানুষটার জন্য শুধু আত্মীয় না, অনাত্মীয়, আশেপাশের গ্রামের সব মানুষরা, সাঁওতালরা, ফকিররা, রিকশাচালক, আশেপাশের সবাই এখনো কাঁদে আর বলে, ‘অমন মানুষ আর তো হবে না কোনদিন।’

বউমনি বলে, ‘সবার মুখে এতো মার গল্প শুনেছি, আমার দেখতে ইচ্ছে করে মানুষটাকে। এতো ভালো কীভাবে হতে পারে মানুষ, তাকে দেখার ভাগ্য হলো না।’ মা কেমন ছিল, মার সঙ্গে আমার বন্ধন কেমন, সেসব মা-ময় দিন, জীবন কেমন ছিল, মাকে ছাড়া আমার কেমন লাগে তা আমি কোনদিন লিখে প্রকাশ করতে পারবো না, কোনদিনও না। তবে মা থাকলে জীবনটা যে অন্যরকম হতো, মাকে আদরে বুক ভরে রাখতাম তা বুঝি। মাকে আল্লাহ জান্নাতে রেখেছেন তাও জানি। মাকে বুকে নিয়েই একটা জীবন বাঁচি রোজ।

mother

যদি আর একবার পেতাম মাকে আর একটিবার, হাতের আঙুলগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম, ভালো করে দেখতাম। যদি আর একবার পেতাম মা তোমায়, পায়ের আঙুলগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। তোমার পায়ের আঙুলগুলিতে হাজারটা চুমু খেতাম। যদি আর একবার পেতাম মা আর একটিবার চুলগুলি তোমার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। যদি আর একবার পেতাম মা তোমার চোখের পাঁপড়িগুলিতে হাজারটা চুমু খেতাম, যদি আর একবার একটিবার ফিরে পেতাম মা তোমার ঠোঁটে মেরিল নয়তো পমেড মেখে দিতাম, তোমার শাড়ির কুচিগুলি ঠিক করে দিতাম। তোমার গায়ের ঐ বর্ণনাতীত ভয়ানক সুন্দর সুবাস নাক ডুবিয়ে নিতাম, নিতাম মা। মা-ছেলে হাঁটতে হাঁটতে সাঁওতাল পাড়া, ধানের ক্ষেত, কবরস্থান ঘুরতাম মা।  সাঝবেলায় হারিকেন জ্বালিয়ে মা-ছেলে শুয়ে, বসে বসে রাজ্যর গল্প করতাম মা। আমি মন খারাপ করা একটি শীতের রাত তোমার কোলে বাচ্চা ছেলেটার মতো মুখ ডুবিয়ে রাখতাম মা। যদি আর একটিবার পেতাম তোমাকে আমার বুকের মাঝে রাখতাম মা, যাতে তোমার একা না লাগে, তুমি তো তোমার ছেলেটার সেরা বন্ধু।

শরতে ঝরা শিউলির মাঝে খুঁজেছি তোমাকে, বরষায় আমাদের ‘ভালোবাসার জান্নাত কুঞ্জ’ এর টিনের চালের বৃষ্টির জলে তোমাকে খুঁজেছি। খুঁজেছি বসন্তে কৃষ্ণচূড়াদের দলে। চড়ুই জোড়াকে বলেছি আমার মাকে দেখেছিস তোরা? সেই মায়ায় ভরা মুখটা, স্বর্গসুখ পাওয়া যায় যে মুখটা একবার দেখলেই। অশান্ত মন শীতল হয় যে মুখের কথাতে। আমাদের গাঁয়ের বুনো ঘাসফুল ছুঁয়ে থাকা শিশিরগুলিকে বলেছি তোরা আমার মাকে দেখেছিস? সেই মায়াবতী অদ্ভুত শান্ত লক্ষ্মী মেয়েটাকে?

>> আরও পড়ুন: দীর্ঘ কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে মা হওয়া এক নারীর গল্প

মা কোথাও নেই। বসন্তের মাতাল সমীরণে নেই, হেমন্তের শেষ বিকেলের রোদে নেই, শীতের সকালের কুয়াশায় নেই। অঘ্রাণের ভোরে নেই। কোথাও নেই। তেরটা শরতে মা আমি খালি পায়ে হাঁটিনি আকাশ দেখতে দেখতে, হেমন্তের রাতে বসে গল্প করিনি। মার হাতের ফুলকপি দিয়ে মাছ, টমেটো ভর্তা, শিম ভাজি, হাঁসের গোস্ত, মাসকালাইয়ের ডাল, খৈ-মুড়কি খাইনি। দুঃখরা ভর করলে মার আঁচলে মুখ লুকাইনি, মনের কথাগুলি খুলে বলিনি, আর কাওকেই বলিনি।

বেহেশত ভালো থেকো মা। আমার লক্ষ্মী মেয়েটা। অনেক আদর।

লেখক: সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, প্রোডাকশন, ল্যাবএইড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর