বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শহরে এসেছিল এক নতুন পাগল

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

শহরে এসেছিল এক নতুন পাগল

নিস্তব্ধ প্রকৃতি। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মধ্যরাতে পথে হাঁটছেন একজন তরুণ। গলা ছেড়ে গাইছেন, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব/ কী যে একা দীর্ঘ রাত/ আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে... আমি তোমাকেই বলে দেব/ সেই ভুলে ভরা গল্প/ কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়।’

এই দৃশ্য অনেক তরুণেরই চেনা। একাকী পথ হাঁটতে হাঁটতে না হলেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কিংবা কানে হেডফোন গুঁজে এ গান শোনা হয়েছে। গান যারা ভালোবাসেন তাদের প্রিয় গানের তালিকায় রয়েছে মন খারাপের গানটি। যে কণ্ঠটি দরদ ভরা আকুতিতে গানটি গেয়েছেন সেটি ‘সঞ্জীব চৌধুরী’র।


বিজ্ঞাপন


জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘দলছুট’ এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। গুণী এই মানুষটি ছিলেন একাধারে সংগীতশিল্পী, সুরকার, লেখক ও সাংবাদিক। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। তার জনপ্রিয় কিছু গান ‘বায়স্কোপ'; ‘চাঁদ’; ‘গাড়ি চলে না চলে না’; ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন’ ইত্যাদি। 

sanjib

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সঞ্জীব চৌধুরী। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম এবং ১৯৮০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। তবে অংকের হিসেব মেলানো বোধহয় তাকে টানেনি। পরবর্তীতে বিষয় পাল্টে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন সঞ্জীব চৌধুরী। কাজ করেছেন আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। ফিচার সাংবাদিকতায় নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেছিলেন তিনি। তার সৃষ্টিশীলতা লেখায় এনে দিয়েছিল নতুন মোড়। বিশেষত, দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার বিভাগ শুরু হয় তার হাত ধরেই।


বিজ্ঞাপন


sanjib

জীবনের জটিলতাকে খুব সহজ করে দেখেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। প্রবাহমান জীবনের গল্পগুলো তাই গানের সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন বারবার। গানের কথা আর কণ্ঠের মেলবন্ধনে প্রকাশ করেছেন প্রেম, বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবাদ আর দ্রোহকে।

প্রেম নাকি দ্রোহ? সঞ্জীবের কাছে দুটোই ছিল এক সুতোয় গাঁথা। তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি, দু’হাতে আগুন তারও… কার মালা থেকে খসে পড়া ফুল, রক্তের চেয়ে গাঢ়?’

কখনোবা গানের মাধ্যমে বিষণ্ণ প্রেমিকের হৃদয়ের কষ্ট প্রকাশ করেছেন। গেয়েছেন- ‘চোখটা এতো পোড়ায় কেন/ ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও/ সমুদ্র কী তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও?’

sanjib

দ্রোহ আর বিরহের গান দিয়ে মাপা যায় না সঞ্জীবকে। এই একই মানুষের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে প্রেমের আকুল আবেদন। পাগল প্রেমিক হিসেবে প্রেমিকার কাছে প্রেম নিবেদন করে তাই হয়তো গেয়েছিলন, ‘তোমার ভাজ খুলো আনন্দ দেখাও করি প্রেমের তরজমা/ যে বাক্য অন্তরে ধরি নাই দাড়ি তার নাই কমা’

পাগলাটে স্বভাবের মানুষটি নিজেকে পাগল ভাবতেই হয়তো ভালোবাসতেন। যে পাগল ভালোবাসা বোঝে, প্রেম বোঝে, যুদ্ধ আর অধিকারের লড়াইও বোঝে। তিনি গেয়েছিলেন, ‘শহরে এসেছে এক নতুন পাগল/ ধরো তাকে ধরে ফেল এখনি সময়/ পাগল রাগ করে চলে যাবে খুজেঁও পাবে না/ পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে ফিরেও আসবে না....মেয়ে আমাকে ফেরাও’। 

সঞ্জীবের গানের কথা যেন শেষ হবার নয়। প্রতিটি গান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন শ্রোতারা। বারবার গেয়েছেন তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে। আমি তোমাকেই বলে দেবো, সাদা ময়লা, সমুদ্র সন্তান, জোছনা বিহার, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, স্বপ্নবাজি প্রভৃতি কালজয়ী গানের সাথে জড়িয়ে আছে সঞ্জীব চৌধুরীর নাম। 

sanjib

বাংলার লোকগানকেও নতুনভাবে সবার সামনে এনেছিলেন এই শিল্পী। গাড়ি চলে না, বায়োস্কোপ, কোন মিস্তরি নাও বানাইছে গানগুলোকে তিনি পরিণত করেছেন নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে।

সঞ্জীব চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে, গাড়ি চলে না/ চড়িয়া মানব গাড়ি/ যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি উপায়-বুদ্ধি মেলে না’। বাউল শাহ আব্দুল করিমের লেখা এ গানের কথাগুলোর মতো সত্যিই থেমে যায় সঞ্জীব চৌধুরীর জীবন গাড়ি। থেমে যায় আকুলতা ভরা সেই কণ্ঠ।

>> আরও পড়ুন: গান গাইলে ভালো থাকে মন

২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই প্রয়াণ ঘটে এই শিল্পীর।

sanjib

১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারের সাথে ব্যান্ড ‘দলছুট’ গড়েন তিনি। সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পার যৌথ উদ্যোগে এই ব্যান্ডের অ্যালবামগুলো হলো- আহ্ (১৯৯৭), হৃদয়পুর (২০০০), আকাশচুরি (২০০২) এবং জোছনা বিহার (২০০৭)।

>> আরও পড়ুন: যাদের কণ্ঠে শোনা যাবে পদ্মা সেতুর 'অফিসিয়াল থিম সং'

নিজের কন্যাসন্তানের নাম কিংবদন্তি রাখেন সঞ্জীব। তাই হয়তো আজও একজন কিংবদন্তির বাবা হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। আর তার গাওয়া গানগুলো বেঁচে আছে শ্রোতাদের মাঝে। তাইতো এখনও কোনো কিশোর বা তরুণ প্রেমে পড়ে প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে গেয়ে ওঠেন, ‘তোমার বাড়ির রঙ্গের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না/ ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি, বাঁয়ের দিকে পুকুরঘাট/ সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না।’

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর