শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন প্রিয় শিক্ষাগুরু সেন্টু স্যারের নাম

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ০২:৪২ পিএম

শেয়ার করুন:

স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন প্রিয় শিক্ষাগুরু সেন্টু স্যারের নাম

বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে নানাবিধ নেতিবাচক কথা শোনা গেলেও এ দুই দলের সম্পর্ক শ্রদ্ধা আর স্নেহের পরশে মাখা যুগ যুগান্তরের। আমার সামান্য শিক্ষাজীবনে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুর স্নেহে ধন্য হয়েছি। তাদের অকৃত্রিম ভালবাসা আর স্নেহে জীবনকে ভরিয়েছি। 

কিছু কিছু সম্পর্ক সময়ের পরিক্রমায় ফিকে হয়ে যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ক আজীবন মনের আকাশে উজ্জ্বল থেকে স্মৃতির মণিকোঠায় আলো ছড়ায়। সেন্টু স্যারের সঙ্গে আমার তেমনই এক পিতা-পুত্রের স্নেহময় আত্মিক সম্পর্ক যা শুধু স্কুল জীবনের চারদেয়ালে আটকে ছিল না বরং তার পরশ ছিল পরবর্তী জীবনে।      


বিজ্ঞাপন


১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৬ কিংবা ৭ তারিখ। বাড়ির কাছাকাছি কোনো মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় আব্বা আমাকে ভর্তি করান লালমোহন হাই স্কুলে। সেদিনই স্যারের সঙ্গে দেখা। পোশাক পরিচ্ছেদে ফিটফাট বেত হাতে রাগী চেহারার মানুষটি সম্পর্কে আগে শোনা গল্পের চেয়ে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। পরে শুনেছি, বাবা তার হারাধনের একমাত্র অবলম্বন যেন বখে না যায় তাই আমাকে ষোল আনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেন্টু স্যারের ওপর নির্ভর করেছিলেন। থানা সদরের প্রধান স্কুলের বিএসসি সেন্টু স্যার দুষ্ট ছাত্র দমন ও নিয়ন্ত্রণে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। সেই থেকে লালমোহনে আমার একমাত্র অভিভাবক সেন্টু স্যার।

>> আরও পড়ুন: ‘আমার প্রিয় জিতেন স্যারের সঙ্গে আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না’
 
আমার থাকার জায়গা হলো লালমোহন হাই স্কুলের ছাত্রাবাসে। পূর্ব পশ্চিমের লম্বা টিনের ঘরের আটটি রুম। কালের বিবর্তনে আমার সেই ছাত্রাবাস আজ শুধুই স্মৃতি। শহরায়ণের অশুভ থাবায় সেই স্থানে আজ বাণিজ্যিক ভবন। কালের পরিক্রমায় একদিন সবাই ভুলে যাবে ঐতিহ্যবাহী সেই লম্বা ঘরটি। এখানেই একদিন সূচনা হয়েছিল লালমোহন স্কুলের প্রাথমিক দিনগুলো। শাহবাজপুর সরকারি কলেজের গোড়াপত্তনও এই ঘরেই হয়েছিল। পরবর্তীতে তা স্কুল ছাত্রাবাস হিসেবে স্থায়ী রূপ লাভ করেছিল। 

প্রতি রুমে চারজন ছাত্র থাকে। সবাই যে আমার মতো দূর থেকে এসেছে তা নয়। অনেকের বাড়ি কাছাকাছি হওয়ার পরও স্কুল হোস্টেলে থাকে। কারণ শুধু সেন্টু স্যারের কঠোর শাসন। তারা তিনবেলাই বাসায় গিয়ে খেয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো। অন্য আরও দুজনের সঙ্গে আমি স্যারের রুমে থাকতাম। স্যার দিনের পুরো সময়ে হোস্টেলে থেকে রাত ১০টার দিকে বাড়ি চলে যেতেন। তখন স্যারের ছেলে উজ্জ্বলও আমাদের সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করতো।

গ্রামের সেই বোকাসোকা ছেলেটার কাছে লালমোহন বাজার বিশাল ঘোরাফেরার জায়গা। রাস্তায় মানুষের জমায়েত দেখলেই দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতাম। রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে বক্তৃতা শুনতাম। ফুটপাতের ওষুধ বিক্রেতার কথা শুনতাম আগ্রহ ভরে। 


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: ‘এখনকার প্রজন্ম একটামাত্র জামার আনন্দ বোঝে না’

কয়েকদিনের মধ্যে কোনো এক দুপুরবেলা রুমের চাবি নিয়ে অবাক বিস্ময়ে ফুটপাতের ওষুধ বিক্রেতার কথা শুনছি। অনেক সময় পার হয়ে যায়। এদিকে স্যার রুমে ঢুকতে না পেরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কোনো একজনকে খুঁজতে পাঠায়। সে আমাকে নিয়ে আসতে আসতে বলে, আজ খবর আছে। অন্য রুমের বড় ভাইরা টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ দেখার অপেক্ষা করে। চাবি নিয়ে ফেরার পর স্যার অমায়িক হাঁসি দিয়ে বলে উঠে, এরে শাহীন্নাহহহ!

বিকেল বেলা স্যারের কাছে অংক করতাম। স্যারের খাটের পাশে লাগোয়া বেঞ্চে আমরা কয়জন পাশাপাশি বসে। স্যার বিএসসি হওয়ায় অংক করাতেন বেশি। ফলে অংকের প্রতি একধরনের ঝোঁক এবং দক্ষতা আজও টের পাই। খুব করে চাইতেন আমি যেন ভালো রেজাল্ট করি। এত এত রাশভারী মানুষটি আমার সব ধরনের খোঁজ রাখতেন। রসিকতা করতেন। খুব করে চাইতেন আমরা কয়জন যেন তাকে আব্বা ডাকি, তার স্ত্রীকে আম্মা। বাড়িতে দাওয়াত দিতেন।  

অবসর জীবনেও বেশ সাবলীল জীবনযাপন করছিলেন। তেমন কোনো রোগের কথা শুনিনি। যে মানুষটির ভয়ে জড়সড় থাকতাম ছাত্রাবস্থায় সেই কিনা রাস্তায় দেখা হলে জড়িয়ে ধরতেন। খুব করে গল্প করতেন। স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়তেন। আমাদের ব্যাচের যাদেরকে বহুদিন দেখেন না, তাদের দেখতে চাইতেন। সকলের খবরাখবর নিতে চাইতেন।      

পুরো নাম শাহাবুদ্দীন সেন্টু। সেন্টু স্যার হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম। লালমোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। ডাওরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ১৯৭৮ সালের ২ মে লালমোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়ে ২০১১ সালের ৮ মে অবসর গ্রহণ করেন।

একজন আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। তদানিন্তন লালমোহনের দুষ্ট ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সম্ভাবনাময় ভালো ছাত্রদের জন্য ছিলেন আলোকবর্তিকা। স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করতেন। বোর্ড স্টেন্ড করানো, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। দুঃচিন্তাগ্রস্থ অভিভাবকদের জন্য ছিলেন আশ্রয়স্থল।

মৃত্যুই শেষ কথা নয়। অনেকেই স্বীয় কর্মে বেঁচে থাকেন। সেন্টু স্যারও বেঁচে থাকবেন তার অগণিত ভক্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে। ক্লাসরুমে ব্যাপক বেত ব্যবহারকারী আতংকিত শিক্ষার্থীদের কাছে একজন শিক্ষকও যে এত প্রিয় হতে পারে, সেন্টু স্যার তার অন্যতম উদাহরণ। আল্লাহ স্যারকে ভাল রাখুন ওপারে।

লেখক: কামাল হোসেন শাহীন, সহযোগী অধ্যাপক, নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা সদর ভোলা।

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর