তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বছরের শুরুতেই কোনো একটা কারণে পুরো ক্লাসের সবাই স্যারের বেত্রাঘাত পেলাম। তবে আমার দুই হাতে জোড়া বেতের বাড়িটা স্যার মনে হয় একটু বেশিই জোরে মেরেছিলেন। দুই হাতের তালু, আঙ্গুল ফুলে একাকার।
টিফিনের সময় স্কুলের দপ্তরি সিদাম দা আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘স্যার ডাকেন।’ ভয়ে আত্মা শুকিয়ে কাঠ। অজানা আতংক, আবারও মাইরের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত! স্যারের ডাকে সাড়া না দেয়ার উপায় নেই। অগত্যা সেই বাচ্চা মানুষ আমি, ভয়ে ভয়ে শিক্ষকরুমে গেলাম।
বিজ্ঞাপন
স্যার আমাকে দেখা মাত্রই আমার দিকে ফিরলেন। হাত দিয়ে ইশারা করলেন কাছে যেতে। আমি ধীরপায়ে, মাথা নিচু করে সামনে এগিয়ে গেলাম। স্যার আমার হাত ধরে বললেন- ‘কী রে বেশি লাগছে?’। আমি মাথা নেড়ে না সূচক অভিব্যক্তি দিলাম। স্যার আমার ডান হাতের তালু দেখলেন। ফুলে ঢোল। এরপরে বা হাতের তালু।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন- টিফিনে কিছু খেয়েছি কিনা। আমি না বললাম। টিফিনে মূলত কিছু খাওয়া হতো না। টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই স্কুলের মাঠে চলে যেতাম। কখনো ক্রিকেট, কখনো ফুটবল খেলতাম। আর কিছুই না থাকলে গোল্লাছুট। ঘেমেনেয়ে একাকার।
এরপর স্যার তার টিফিনবক্স খুললেন। একটা রুটি তার মধ্যে আলুভাজি দিয়ে রোল করে আমার হাতে দিয়ে বললেন- ‘দুইটা রুটি এনেছি। একটা তুই খাবি আরেকটা আমি’। খাবো না- এটা বলার সাহস ছিল না। মনের ভেতরে স্যারের প্রতি অভিমান, কিছুটা কষ্ট তখন প্রবলভাবে চলছিল। তবুও স্যারের দেয়া সেই রুটি না খেয়ে পারলাম না। খাওয়া শেষে স্যার বললেন- ‘আমার ক্লাসে তোর কাছে কখনো যেন শুনি না যে পড়া হয় নাই বা অ্যাসাইনমেন্ট হয় নাই, বোঝা গেলো?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম- জি স্যার।
বিজ্ঞাপন
আমার ফোলা হাত দেখে হয়তো স্যারের মনেও দুঃখবোধ হয়েছিল, কিন্তু শিক্ষক তো পাহাড়ের মতো শক্তিশালী। ভেতরে ক্ষরণ হলেও ওপরে প্রকাশ করেননি।
জিতেন চন্দ্র সাহা। ইনিই আমার সেই শিক্ষক। বাংলার শিক্ষক। স্যার সাদা রঙের ৫০ সিসি মোটরসাইকেল চালাতেন। অদ্ভুত শব্দ হতো সেই বাইকের। স্যারের বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামের ঠিক পেছনের গ্রাম। স্যারের যাতায়াত হতো আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে। অনেক সময়ই স্কুলসময় বাদ দিয়েও স্যারের সাথে দেখা হতো। দূর থেকে দেখা মাত্রই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম আমি।
২০১৭ সালের কথা। আমি আর আমার বন্ধু সালেকিন সকাল দশটার দিকে আমাদের এলাকার বেশুলিয়াতে (বেলকুচি+আশুলিয়া= বেশুলিয়া) বসে ছিলাম। দূর থেকে ফিফটি মোটরসাইকেলে কাউকে আসতে দেখে সালেকিনকে বললাম- ‘জিতেন স্যার না?’। সালেকিন তেমন পাত্তা দিল না আমার কথাকে। আমার চোখ ওইদিকেই।
কিছুটা কাছে আসা মাত্রই বুঝতেন পারলাম স্যার। আমি মুহূর্তেই লাফ দিয়ে সেই স্কুলসময়ের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাকে ক্রস করার সময় সালাম দিলাম। মনে হলো উনি শুনেননি। কিন্তু ১৫-২০ হাত পরেই বাইক থামল। স্যার পিছনে তাকালেন। আমি প্রায় দৌড়ে গেলাম। গিয়ে আবার সালাম দিলাম। স্যার চিনলেন। বাইক থেকে নেমে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন- ‘মোহাম্মাদ আলী না? এত বড় হয়ে গেছিস তুই?’ স্যার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন- ‘বাহ, লম্বায় তো তুই আমার চেয়েও বড় হয়েছিস রে!'
এরপরে রাজ্যের কথা স্যারের সঙ্গে। স্যার একের পর এক প্রশ্ন করছিলেন, আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আলাপচারিতার শেষের দিকে এসে কানের দিকে হাত দিয়ে বললেন- ‘চুল এতো বড় হইছে কেন? চিপ এতো বড় রাখা তো ভদ্রতা নয়’। আমি মাথা নিচু করে বললাম- জি আচ্ছা স্যার। এরপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে স্যার বিদায় নিলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার একবার পিছনে ফিরলেন। এরপর আর ফিরে চাইলেন না। আমি তখনও স্কুলজীবনের স্যারের সাথেকার স্মৃতির জাবর কাটছি।
স্যার চলে যাবার পরে সালেকিনের কাছে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ বসে থেকেই সালেকিনকে বললাম- ‘চল বাজারে যাবো’। সে অবাক বলল- ‘হঠাৎ বাজারে? আর এখন তো বাজার নাই, অনেক বেলা হইছে, মাছটাছ পাওয়া যাবে ন’'। আমি বললাম- ‘বাজার করতে না, চুল কাটাতে যাবো, একদম আর্মি কাট, ছোটবেলায় যেমনটা দিতাম’। ও বলল- ‘হঠাৎ?’। আমি ঘটনা বললাম। সে অবাক হলো। কিছু না বলে বলল- ‘চল’।
২০২০ এ রোজার ঈদে বাড়িতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো স্যারের সঙ্গে দেখা করবো। স্যার অবসরে গিয়েছেন এটা জানতাম। তাই স্যারের বাড়ির দিকেই গেলাম। আগে কখনো যাইনি। তাই ওই এলাকায় গিয়ে স্যারের কথা বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। সবাইই জানালো- স্যার একেবারে ইন্ডিয়া চলে গেছেন। এখানে জমিজমা নিয়ে সম্ভবত তার আত্মীয়দের সাথে ঝামেলা হয়েছিল। এরপরে স্যার নিজের ভাইবেরাদরদের সঙ্গে অভিমান করে দেশ ছেড়েছেন!
এসব শোনার পরে কেন যেনো বিষাদে মন ভরে উঠলো। আমার প্রিয় জিতেন স্যারের সঙ্গে আর কখনোই দেখা হবে না! আর কখনোই হয়তো দেখবো না সাদা রঙের ফিফটি মোটরসাইকেল চেপে চশমা পরা আমার স্যার এগিয়ে আসছেন! আর কখনোই হয়তো বলবেন না- ‘কিরে চুল বড় কেন, হ্যাঁ?’। কখনোই সেই স্নেহের হাত আমার মাথায় আর পরশ বুলাবে না!
আজ শিক্ষক দিবস। আমার প্রিয় জিতেন স্যারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। সৌভাগ্যগুণে ফের স্যারের সঙ্গে দেখা হলে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে এবার হয়তো আমিই বলবো- স্যার আপনার সেই আমি এখন আরও বড় হয়েছি, দেখেন স্যার দেখেন।
যেখানেই আছেন, যেভাবেই আছেন জিতেন স্যার, আপনি ভালো থাকুন। সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুন। শ্রদ্ধা।
লেখক: আইটি এক্সপার্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ
এনএম