পূজা মানেই আনন্দ। আর সেই আনন্দ সবচেয়ে বেশি ছোটদের। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূজার আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব শরৎকালীন দুর্গোৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। মূলত পিতৃভক্ত রামপত্মী সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য অকালে দেবী দুর্গার বোধন করেন। সেই থেকে বসন্তকালে দুর্গাপূজার জায়গায় শরতকালে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মফস্বলে। তাই পূজার উন্মাদনা বেশ আগেই শুরু হতো। পূজার কাঠামো যেদিন পরতো সেদিন থেকে আমার দিনগোনা শুরু হতো। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে আর স্কুল থেকে ফিরে রুটিন করে প্রতিমা বানানো দেখতাম। কীভাবে ভাস্কর কাঠের কাঠামোতে খড় দিয়ে বাঁধে তারপর মাটি ধরান তা দেখতাম।
বিজ্ঞাপন
একমেটে দোমেটে করা দেখতে দেখতে পূজার দিন ঘনিয়ে আসতো। তারপর নতুন কাপড় কেনার ধুম পড়তো পাড়াময়। মা-বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়েই কাপড় কিনতেন। সেসময় কম বেশি সবার একটাই নতুন জমা হতো। সেই জামা লুকিয়ে রেখে দিতাম কাউকে দেখানো যাবে না। পূজার দিন পরতে হবে তাই। নাহলে পুরনো হয়ে যাবে।
প্রতিমাকে রঙ উপযোগী করে ভাস্করেরা চলে যেতেন অন্য জায়গায়। তবুও পাড়ার ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে সকাল বিকেলে প্রতিমা দেখতাম মন্দিরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। গল্প চলতো অসুরটা কেমন হলো, গণেশের পেট মোটা নাকি চিকন হলো। দেখতে দেখতে পূজার সময় এগিয়ে আসতো। এবার প্রতিমা রঙের পালা।
রঙ করা প্রতিমার সজ্জা, মন্দিরের সজ্জা শেষ হতেই মন্দিরের সামনে থেকে ঢেকে রাখা হতো প্রতিমা। তবুও সেই ঢাকনার ফাঁক ফোকর গলে আমরা প্রতিমা দর্শন করতাম। মায়ের ব্যস্ততা ছিল ঘর ঝাড়া মোছা, নাড়ু, খই, মোয়া, মুড়কি বানানোতে। পূজার সবচেয়ে কাছের দিন মহালয়া। ওইদিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। পূজার আয়োজনের আগের সময়টাতে আমি আমাদের বাড়িতে থাকলেও মূল পূজার আনন্দ আমার মামা বাড়িকে ঘিরে হতো।
বিজ্ঞাপন
আমার ছোটবেলার পূজা ঘিরে সবচেয়ে মধুর স্মৃতি মামারবাড়ির পূজা নিয়ে। আমার মামাদের বাড়িতে নিজেদের পূজা হতো, এখনও হয়। বিরাট বাড়িতে প্রচুর লোকজন আর মামাতো বোনদের ছত্রছায়ায় আনন্দ বহুগুণ হতো। দলবেঁধে মামাতো ভাইবোন আর মামিদের সাথে মন্দিরের সামনের বিরাট সিংহদরজার ভিতরে চেয়ার পেতে বসে থাকতাম সন্ধ্যেবেলায়।
মামাবাড়ির পূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন। মামাতো বোনেরা সবাই শ্বশুরবাড়ি থেকে আসতো। তারাই সেসব উলু, শাঁখ প্রতিযোগিতা জিতে নিতো। আরও হতো ধুনুচি নাচ। আমার মামার বাড়ির পূজার মূল আকর্ষণ দুটো ছিল। একটা নবমীতে কাদা খেলা আর অন্যটা দশমীতে ভাসান।
নবমীর সকালে পূজার পর কাদা খেলা শুরু হতো। ছেলে-বুড়ো সকলে মিলে অংশ নিতো সেই খেলায়। আর দশমীতে কপোতাক্ষের বুকে বড় বড় নৌকায় চড়ে মা পিতৃগৃহ ত্যাগ করে চলতেন স্বামীর ঘরের উদ্দেশে। নৌকায় করে অত্র এলাকার সকল প্রতিমা তুলে ঘোরানো হতো। দশমীর বিকেলে সিঁদুর খেলা আর দেবী মাকে বরণের পর ভাসানের প্রস্তুতি শুরু হতো। প্রতিমা বিসর্জনের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা হতো গুরুজনদের। সবার বাড়িতে গেলেই সেদিন জুটতো লুচি, মিষ্টি আর মাংস। নিজেদের বাড়িতে পূজা হওয়ায় আমার মামাবাড়িতে পূজার কদিন মাছ মাংস খাওয়া হতো না।
ছোটবেলার পূজা এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। বড় হয়ে সেই আনন্দটা আর নেই। ধীরে ধীরে সব হারিয়ে গিয়েছি। নিয়ম করে এখন আর প্রতিমা বানানো দেখার সুযোগ নেই। চাকরিজীবী হিসেবে গোনা ছুটি নিয়ে যেতে হয় বাড়িতে। সেই মামাবাড়ির পূজা, একটা জামা কিনে লুকিয়ে রাখার আনন্দ, পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে প্রতিমা দেখতে যাওয়াকে ভীষণভাবে মিস করি।
পূজার আরেকটা জিনিস বড্ড আকর্ষণীয় ছিল দাদু ঠাম্মা বেঁচে থাকতে। দাদু আমার বেশ ছোটবেলাতেই চলে গিয়েছেন। তার স্মৃতি আবছা। তবে একটু বড় হওয়ার পরে ঠাম্মার সাথেই কেটেছে আরও সুন্দর সময়। ঠাম্মা পূজার মেলায় যাওয়ার জন্য পয়সা দিতেন। মেলা থেকে লাল, নীল জলভর্তি কাঁচের একটা দুমুখ আটকানো নল কিনতাম। তার ভিতরে থাকতো জরি। চেষ্টা চলতো কারটা কতোদিন টিকে যায়। আর কিনতাম বাঁশের চরকা গাড়ি।
একবার পূজোয় ঠাম্মা একটা জামা দিয়েছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন বাবা যেন আমার জন্যে জামা আনেন, টাকা ঠাম্মা দিবেন। জামাটা ছিল একটা স্কার্ট। সবুজ টাইপের একটা স্কার্ট আর কোটি সঙ্গে সাদা শার্ট। এখন পাঁচটা পোশাক কিনলেও সেই জামাটার কথা ভুলতে পারি না।
এখনকার প্রজন্ম দিনরাত এক করে প্রতিমা বানানো দেখা, একটামাত্র জামার আনন্দ বোঝে না। বিশেষ করে ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পূজার আনন্দ আসে শুধু ছুটিতে বাড়ি ফেরা আর কারো কারো ঢাকাতে থেকেই বাবা মায়ের সঙ্গে একদিন প্রতিমা দর্শন, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, মোবাইলে গেম খেলে ছুটি পার করে। আমাদের ছোটবেলার আনন্দ আবার ফিরে আসুক নতুন প্রজন্মের মধ্যে।
তবে বর্তমানে বড় হওয়ার পর পূজার আনন্দ অন্যরকমভাবে অনুভব করি। সকলকে ছোটোখাটো উপহার দেওয়া আর তাদের হাসিমুখ দেখতেই ভালো লাগে।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ
এনএম