হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকদের বুক চাপ দিতে দেখবেন। অনেকবার চাপ দেওয়ার পর রোগী সাড়া দেন, তার জ্ঞান ফেরে। আবার কখনো এই চাপেও লাভ হয় না। রোগী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ডাক্তার কেন রোগীর বুকে এভাবে চাপ দেন? কেউ কেউ আবার অভিযোগও তোলেন যে, বুকে চাপ দিয়ে রোগীকে মেরে ফেলেছেন ডাক্তার। আসলে কেন এই কাজটি করা হয়? জানুন এই প্রতিবেদনে-
হার্ট অ্যাটাকের রোগীর বুকে চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সিপিআর (CPR) বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (cardiopulmonary resuscitation) বলা হয়। এটি একটি জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি। একজন ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাক করার পরবর্তী ২ ঘণ্টাকে গোল্ডেন আওয়ার বা সোনালি সময় বলা হয়। এই সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড রোগীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হার্ট অ্যাটাকের পর যত দ্রুত সঠিক নিয়মে সিপিআর দেওয়া যাবে তত রোগীর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা বাড়বে। তবে আনাড়ি কেউ কাজটি করলে উল্টো বিপদ হতে পারে। ভাঙতে পারে রোগীর পাঁজরের হাড়।
বিজ্ঞাপন
সিপিআর কী?
সিপিআর একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যা জরুরি অবস্থায় হৃৎপিণ্ড এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত এটি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া) বা শ্বাসরোধজনিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়। সিপিআর দুটি প্রধান উপাদানের সংমিশ্রণে সম্পন্ন হয়। বুকের সংকোচন (চেস্ট কমপ্রেশন) এবং কৃত্রিম শ্বাস (রেস্কিউ ব্রিদিং)।
বিজ্ঞাপন
সিপিআর বা বুকে চাপ দেওয়া হয় কেন?
অক্সিজেন সরবরাহ: সিপিআরের মূল লক্ষ্য হলো মস্তিষ্ক এবং হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেনযুক্ত রক্তের প্রবাহ বজায় রাখা যেন টিস্যুগুলোতে অক্সিজেনের অভাব না হয়।
মস্তিষ্কের ক্ষতি প্রতিরোধ: অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিপিআর দ্রুত প্রয়োগ করলে এটি রোধ করতে পারে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।
রক্ত সঞ্চালন পুনরুদ্ধার: সিপিআরের মাধ্যমে বুকে সংকোচন সৃষ্টি করা হয়। এর দ্বারা রক্ত সঞ্চালন চালু রাখা হয়, যা প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোতে রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করে।
সিপিআর দেওয়ার নিয়ম
একজন হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে সিপিআর জাদুকরি প্রভাব ফেলে। তাই সবারই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। সিপিআরের নির্দিষ্ট কিছু ধাপ আছে। সেগুলো জেনে নিন।
প্রথমেই আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের অবস্থা দেখে নিতে হবে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করুন।
এবার আক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞান আছে কিনা দেখুন। জ্ঞান থাকলে তাকে স্বাভাবিকভাবে চিৎ করে শুইয়ে দিন যেন ধীরস্থিরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন।
জ্ঞান না থাকলে তার শ্বাস নেওয়ার পথ যেমন- নাক, মুখ ও গলার ভেতরের অংশ পরিষ্কার আছে কিনা দেখুন। মাথা পেছনের দিকে টেনে, থুঁতনি ওপরের দিকে তুলে শ্বাসনালী খুলে দিতে হবে। যদি কফ-রক্ত বা অন্য কোনো কিছু এপথে আটকে থাকে, তবে তা সরিয়ে শ্বাস নেওয়ার পথ করে দিতে হবে এবং সিপিআর প্রয়োগ শুরু করতে হবে।
ব্যক্তির এক পাশে এসে বুক বরাবর বসে এক হাতের তালুকে বুকের মাঝ বরাবর ও একটু বামদিকে স্থাপন করতে হবে। তার উপর অপর হাত স্থাপন করে উপরের হাতের আঙুল দিয়ে নিচের হাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। এসময় হাতের কনুই যেন ভাঁজ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হাত সোজাভাবে রেখে বুকের ওপর চাপ দিতে হবে।
এমন গতিতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যেন প্রতি মিনিটে ১০০-১২০টি চাপ প্রয়োগ করা যায়। এভাবে প্রতি ৩০টি চাপ প্রয়োগের পর আক্রান্তের মুখে মুখ রেখে দুই বার ফুঁ দিতে হবে। কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে রেসকিউ ব্রেথ বলে। এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যেন বুকের পাঁজর ২ থেকে ২.৫ ইঞ্চি নিচে নামে। যেন হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ পড়ে।
হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বা জ্ঞান ফিরে আসা অথবা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস চালু হওয়া পর্যন্ত একইভাবে সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
জ্ঞান ফিরলে বা শ্বাস-প্রশ্বাস চালু হলে তাকে একপাশে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। এরপর পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
সিপিআর করার ক্ষেত্রে সাবধানতা
বুকের চাপ দেওয়ার গতি ও গভীরতা সঠিকভাবে বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি চাপ দেওয়ার গতি কম বা বেশি হয়, তাহলে রক্তের সঞ্চালন কমে যেতে পারে এবং এটি গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইউটিউবে এ বিষয়ে অনেক ভিডিও রয়েছে। সেগুলো দেখলে কাজটি কীভাবে করতে হবে তা সহজে বুঝতে পারবেন।
সিপিআরে কাজ না হলে করণীয়
কখনো কখনো সিপিআর দেওয়ার পরও রোগীর জ্ঞান ফেরে না। সেক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করতে বৈদ্যুতিক শক (ডিফিব্রিলেশন) প্রয়োজন হতে পারে। সিপিআর করার সময় ডিফিব্রিলেটর ব্যবহার করা হলে এটি রক্ত সঞ্চালন চালু রাখার পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডের ছন্দ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
সিপিআর একটি জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রক্রিয়া। যেকোনো অবস্থাতেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সিপিআর দেওয়ার প্রক্রিয়া শেখা ও প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে সিপিআর প্রয়োগ করলে তা একটি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।
এনএম