মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

‘আমরা হুমায়ূনের প্রভাবে আক্রান্ত’

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

Humayun Ahmed

এক। 

হুমায়ূন আহমেদের উত্থানটা রাজকীয়। কিন্তু তার পেছনে একটি গল্প আছে। এ গল্পটা তিনি নিজেই সহজভাবে বলেছেন, এতোটা সহজ তার সমসাময়িকদের মধ্যে পাওয়া যায় না। তার বেড়ে উঠা, তার ‘হুমায়ূন আহমেদ’ হয়ে ওঠা অনেক বড় গল্প। এখানে আনন্দের সঙ্গে বেদনার একটা সপ্রতিভ কেমিস্ট্রি আছে। 


বিজ্ঞাপন


প্রাণখোলা হাসি আর অমিত সৃষ্টি উল্লাসী আহমেদ ছফা। তিনি হুমায়ূন আহমেদের বই বের করার উদ্যোগী হলেন। বইটি বাংলাবাজারের খান ব্রাদার্স থেকে বেরও করলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হলো ‘নন্দিত নরকে’ তাঁর প্রথম বই। এই বইটি তখনই জানান দিয়েছিল বাংলাসাহিত্যে তিনি হারিয়ে যাবেন না। সেটা টের পেয়েছিলেন লেখক-সমালোচক শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ। এ বইতে ভূমিকায় তিনি হুমায়ুন আহমেদকে অভিনন্দিত করেছেন। হুমায়ূন আহমেদকে হীরে ভেবে ভুল করেননি তিনি।

দুই। 

মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশ বাংলাদেশ, যুদ্ধবিধ্বস্তে পর্যদস্তু। তখন চারিদিকে ভারতীয় বইয়ের আগ্রাসী। হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে, এই বইটি বাংলাদেশের লেখকদের পাঠক সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রেখেছে। একজন লেখক হিসেবে এদেশের পাঠক তৈরি ও জাগরণে তার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অনেকের কাছেই একজন আদর্শ তিনি। আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন তারই অনুপ্রেরণায় বড় লেখক আজ। 

আজ একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কয়েক বছর আগের কথা। 


বিজ্ঞাপন


লেখালেখি জগতে কেবল পা রেখেছি সবে। প্রথম লেখা গল্প নিয়ে আনিসুল হকের কাছে গিয়েছি। তিনি আমার লেখা দেখে বললেন, ‘তুমি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ো, তাই না?’ আমি বললাম, জ্বি। তিনি বললেন, ‘হুমায়ুনের প্রভাব তোমার গল্পে আছে।’ আমিও বললাম, আপনার গল্পেও তো আছে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আমরা হুমায়ূনের প্রভাবে আক্রান্ত।’

তিন। 

সহজ এবং বোধগম্য ভাষায় কঠিন কথাটি সহজভাবে তুলে ধরার কঠিন কাজটি অনায়াসে সহজে করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখা যেমন সহজ-সরল, তেমনি আমাদের মতো পাঠকগ্রাসী। তবে এ-কারণেই কেবল হুমায়ূন আহমেদ ‘গল্পের জাদুকর’ হননি। হয়েছেন উইট-বহুল লাইফস্টাইলের দরুণ। তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কথা তুলে আনলেন তার নিজস্ব স্বকীয়তায়, নিজস্ব ঢংয়ে। এ এক ভিন্ন এবং তার নিজস্ব ভঙ্গি যা পাঠককে সহজেই অদ্ভুত জাদুকরি আকর্ষণে মুগ্ধ করছে। 

কারণ তাদের মনে হয়েছে তাদের কথাই কেউ বলছেন, যা বুঝতে তাদের কষ্ট হচ্ছে না। গদ্য-সাহিত্যকে তিনি সাধারণ মানুষের ভাবনার, বোঝার এবং উপলব্ধির কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। মিসির আলী, বাকের ভাই, হিমু, শুভ্র, রূপা—মধ্যবিত্তের ভেতর বসত এইসব চরিত্র সময়ের পরিক্রমায় কালজয়ী হয়ে উঠেছে। কখনো হিমু কখনো শুভ্র, কখনো বা মিসির আলীর সহজ-সন্ন্যাসের মধ্য দিয়ে জমিয়ে তোলেন জীবনের বটমূল। চরিত্রদের একেকজন যেন জীবন নদীর খেয়া পারের মাঝি। ঢেউ-ঝড়-তুফান ডিঙ্গিয়ে পারাপারের একটাই মোক্ষ, জীবনের তট-দিগন্তরেখার চিত্রায়ণ।

লেখক-পাঠক হিমুর উপন্যাসগুলো দুজনেরই মন ভাল করে দেয়, এক ধরনের সিরিওকমিক এন্টারটেনমন্ট, যা পাতায় পাতায় আপনাকে হাসাবে, তবু হিমুর কাহিনিগুলো নিছক বিনোদনের জন্য নয়। ফাজলামির ফেনা সরালে নজরে পড়বে এক গাঢ় রসের পাক, তাতে এক দিকে নাগরিক সভ্যতার ভণ্ডামি নিয়ে চোরাবিদ্রুপ, আবার অন্তর্লীন বিষাদ, মায়াবাঁধনের তার কেটে বেরিয়ে আসার করুণ প্রয়াস, মায়াবী কল্পকাহিনী।

চার। 

মধ্যবিত্তের টানাপোড়ন আছে, কিন্তু তার মধ্যে লজিক এবং এন্টিলজিক নিয়ে কাজ করে, সেগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে এসব চরিত্রগুলো। হুমায়ূন তার নাটকের চরিত্র নির্দোষ বাকেরের ফাঁসির সিদ্ধান্তে লাখো মানুষ মিছিল বের করার মতো ক্ষমতাধর নাট্যকার, তেমনি দেশের দুঃসময়ে ‘তুই রাজাকার’ কথাটি প্রথম উচ্চারণ করিয়েছিলেন টিয়া পাখির মাধ্যমে।

যাপনের দিক দিয়ে হুমায়ূন ছিলেন পুরোদস্তুর শহুরে। অথচ গ্রামকে বাদ দিয়ে বা ভুলে গিয়ে নয়। কথাবার্তায় চিন্তা-চেতনায় মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই তাঁর বসবাস। জীবনকে তিনি স্রেফ সাহিত্য দিয়ে ঢেকে দিতে চাননি। বরং শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-ধর্ম থেকে জীবনকেই বেশি প্রচার দেন। বড় এবং মহৎ করতে কখনোই কসুর করেননি জীবনের নিজস্ব সত্যাসত্যকে।

পাঁচ।

হুমায়ূন আহমেদ এর নাটক মানেই ছিল সারাদিনে একসময় আমাদের জন্য অনেক বড় বিনোদন। আমি তখন ছোট। সে সময় একমাত্র সম্প্রচার বিনোদন মাধ্যম ছিল বিটিভি। দেখা ধারাবাহিক নাটকগুলোর মধ্যে প্রথম সবচেয়ে পুরনো যে নাটকটি কথা মনে পড়ে তা হলো বহুব্রীহি, এর আগে প্রচারিত আরো দু একটা নাটকের নাম আর দু একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়লেও তা ঠিক স্মৃতির পর্যায়ে নেই। যেমন সকাল সন্ধ্যা আর এইসব দিন রাত্রি। বহুব্রীহি ছিল এক কথায় দম ফাটানো হাসির নাটক। 

বহুব্রীহি নাটকে টিয়া পাখির কণ্ঠে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি এখনও মানুষে মুখে মুখে ফেরে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি নিরব এবং সরব ধিক্কার জানানোর ভাষা এর চেয়ে আর বড় কী ছিলো! এ একটি সংলাপ দেশের মানুষের অন্তর, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, তাদের সন্তানদের মনে ভয় ধরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সংগ্রামকে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে গেছে এই একটি সংলাপ।

বহুব্রীহি প্রচারের কিছু বছর পর শুরু হলো কোথায় কেউ নেই। আমার মতে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি নাটক। আর কোনো টিভি নাটকের এরকম ও পোস্টার বিক্রি হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই, তখন আরেকটি জিনিস প্রচলিত ছিল তা হলো ভিউকার্ড। পোস্টার কেনার মত তখন সামর্থ্য না থাকলেও বাকের, মোনা, মজনু আর বদির বেশ কিছু ভিউকার্ডের মালিক হয়েছিলাম। আর বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে মিছিল আমাদের দেশের নাটকের ইতিহাসে মনে হয় একটি অনন্য ঘটনা। অয়োময়, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত-এইসব নাটকগুলোতো ভোলারই নয়।

তারপর চলচ্চিত্র যখন মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে, অস্থির আকাশে নিমজ্জিত হচ্ছিল, তখনই হুমায়ূন আহমেদ আসলেন, নান্দনিক-সুস্থ চলচ্চিত্র নিয়ে। আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, দুই দুয়ারি, নয় নম্বর বিপদ সংকেত-শুধু সুধীজনদের সপ্রশংস হয়নি শুধু, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরকে হলমুখী করেছে বহুদিন পর।

ছয়।

যত বড় লেখক তত সমালোচনা। কিন্তু তিনি সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কয়েকবছর আগে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তিনি অনশন করেছিলেন। আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমার এখনও মনে পড়ে তখন আমি এ কার্যক্রমের নোয়াখালীর সংগঠক। দেখলাম সেদিন হুমায়ূন আহমেদের আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হলো সমবেত হলো অসংখ্য মানুষ।

সাত।

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। তবে যা আছে, বিচ্ছিন্ন। হুমায়ূন আহমেদের একটা অটোগ্রাফ পেয়েছিলাম, যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছাকাছি যাওয়ার স্মৃতির চেয়ে বেশি ভালো লাগা। ক্যানসার কেড়ে নিলো হুমায়ুন আহমেদকে। এমন তো কথা ছিল না। চাঁদনি পসর রাতে মারা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক স্বপ্ন পূরণ অসমাপ্ত রেখে অমাবস্যা রাতে চলে গেলেন। মধ্য ষাটের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন মানুষ, যিনি নিজে পাঠক তৈরি করেছেন, সেই পাঠকদের মনে বসত করেছেন, তিনি চলে গেলেও আছেন।

এনএম 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর