রোববার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

৩.৪ মি.মি ব্যাসের বৃত্তে নুশরাতের ‘সঞ্চিতা’

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০২:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

entrepreneur
ছবি: সম্পাদিত

জীবন বয়ে যায় নিজের নিয়মে। নানা দায়িত্ব আর কর্তব্য এসে ভিড় জমায় আমাদের কাঁধে। তবু নিজের ইচ্ছা আর স্বপ্নগুলো উঁকি দেয়। কেউ সেগুলোতে পাত্তা দেন না। কেউবা একটু ভিন্ন ধাঁচে সাজাতে চান রোজকার জীবন। 

নুশরাত জাহান জেবা একজন স্বপ্নবিলাসী নারী। নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। চাকরির পাশাপাশি আলপনা টিপ বানান তিনি। কখনো গড়েন গয়না। চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা এই নারীর সঙ্গে কিছু সময় আড্ডা হয় ঢাকা মেইলের। জীবনের নানা গল্প উঠে আসে সেই আড্ডায়। 


বিজ্ঞাপন


uddokta3

নুশরাতের জন্ম ১৯৮৩ সালে বগুড়া জেলায়। বাবার পেশার সুবাদে স্কুল আর কলেজে পড়েছেন চট্টগ্রামে। এরপর ঢাকার মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় ডিপ্লোমা করেন। পরবর্তীতে স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে একই বিষয়ে বিএ সম্পন্ন করেন তিনি।   

ছেলেবেলার স্মৃতি জানতে চাই নুশরাতের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা স্কুল কমিটির সভাপতি ছিলেন। শিক্ষকদের কাছে এজন্য স্নেহ পেলেও বিড়ম্বনায় পড়তে হতো সহপাঠীদের কাছে। বিশেষত ছেলেরা সবসময় চেষ্টা করত কীভাবে আমাকে শায়েস্তা করা যায়। অহেতুক ঝগড়া করত, মারামারি বাধানোর চেষ্টা করত। একবার বকুল নামের এক বন্ধু ঝগড়া করে আমাকে হুমকি দিয়েই বসে। এরপর একদিন সে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ঘটনায় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আহতও হই।’

uddokta2


বিজ্ঞাপন


‘এই ঘটনার পর অনেক দিন বকুল স্কুলে আসেনি মারের ভয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত সে মার খেয়েছিল। এখন এই বকুল আমার খবর নেয়, অনেকবার স্যরি বলছে। ঢাকায় এলে দেখা করে যায়। এমন অনেক মজার বা কষ্টের স্মৃতিতেই কেটেছে শৈশব’— যোগ করেন তিনি। 

পেশাগত দিক থেকে নুশরাত বর্তমানে একটি ইন্টেরিয়র ফার্মে ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি একজন অনলাইন উদ্যোক্তাও তিনি। তারা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সঞ্চিতা’। কীভাবে অনলাইন ব্যবসায় এসেছেন জানতে চাই সেই গল্প। নুশরাত বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রথম আলোর নকশাতে গীতিকার আলনা টিপ দেখি। ছবির নিচে লেখা ছিল কীভাবে নিজে নিজে সেটি করা যায়। আমার মনে হলো আমিও তো পারি এভাবে করতে। আমার এক অকৃত্রিম বন্ধুকে বললাম ইচ্ছের কথা। সে আমাকে অভয় আর উৎসাহ দিল। আমি আসলে কিছুই জানতাম না। কীভাবে পেজ ওপেন করতে হয়, কীভাবে চালাতে হয় কিছুই জানা ছিল না। সেই বন্ধুটি আমাকে সাহস দেয়। এরপর নিজেই পেজ খুললাম। এভাবেই অনলাইন জগতে পদার্পণ।’

uddokta5

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ সঞ্চিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছেন নুশরাত। তিনি বলেন, ‘নজরুল যেমন তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীগুলো সঞ্চয় বা জমা করে এক অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ দিয়েছেন,যেটা জীবনের কথা বলে,উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যোগায় আমিও আমার ভালোবাসা, আদর, সততা সব একসঙ্গে করে মানুষের মাঝে বিলাতে চাই, তাদের সাজাতে চাই।’

২০১৭ সালে শুরু করলেও করোনাকালীন বন্দি সময়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেন নুশরাত। পণ্যের উপকরণ পছন্দ করা থেকে শুরু করে প্যাকেট করা— সব একাই সামলান তিনি। নুশরাতের মূল পণ্য ৩.৪ মি.মি ব্যাসের বৃত্ত মানে টিপ বা বিন্দি। সঙ্গে কিছু গয়নাও বানান তিনি। 

uddokta4

২০০০ টাকা পুঁজিতে কাজ শুরু করেছিলেন নুশরাত। বর্তমানে মাসে সম্মানজনক আয় করছেন তিনি। ভিন্ন চার্ম দিয়ে টিপ গড়তে ভালোবাসেন এই উদ্যোক্তা। নুশরাত বলেন, ‘বড় চার্মগুলো নানাভাবে কেটেকুটে নতুন শেপে আনি। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক চার্ম নষ্ট হয়। অনেকসময় হাত কেটে যায়। তাও কষ্টের পর যখন নতুন শেপ দিতে পারি তখন নিজের কষ্ট সার্থক মনে হয়।’

কীভাবে টিপ তৈরি করেন, কোনদিকগুলোতে বেশি গুরুত্ব দেন জানতে চাইলে নুশরাত বলেন, ‘সবাই ভাবে এই টিপ বানানো সহজ। আসলে এটি কঠিন কাজ। এত ছোট বৃত্তকে নিজের আনন্দে সাজাতে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়। ক্রেতার চেহারার ধরন অনুযায়ী চার্ম ভালো লাগবে কিনা, কীভাবে চার্ম বসালে সুন্দর লাগবে, কয়টা লেয়ার হবে— এমন অনেক কিছু ভেবে তারপর টিপ বানাতে হয়।’

uddokta6

ব্যবসা করতে গিয়ে নানা ভালোমন্দ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন এই নারী উদ্যোক্তা। নুশরাতের ভাষ্য, ‘মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নানা মানসিকতার সেলার ও ক্রেতা পেয়েছি এই অল্প কদিনে। তাদের হরেক রকম কথার তীরে, বিভিন্ন প্রকার ব্যবহারে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করতে হয়েছে বহুবার। আবার অপর দিকে এমন ক্রেতা আছেন যারা এককাপ চা অফার করেছেন, বাসায় যেতে বলেছেন।এমন সেলার আছেন যারা টাকা পরিশোধ করতে দেরি হলেও একবারের জন্যও চাপ দেননি।’

নানাকারণে থেমে যেতে হয়। কীভাবে তখন নিজের মনকে সামলান। নুশরাত জানান, প্রতিদিন সকালে অন্তত ১৫-২০ মিনিট মেডিটেশন করার চেষ্টা করেন তিনি। এসময় নিজেকে দেখতে চেষ্টা করেন। ভুল থেকে সমাধানের রাস্তা খোঁজেন। পরিকল্পনা করেন কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলা যায়। 

uddokta7

অনলাইন ব্যবসার এই যাত্রাপথে কি পরিবারকে পাশে পেয়েছিলেন? কিছুটা বেদনা বিধুর হয়ে নুশরাত উত্তর দেন, ‘আমাকে অনেকে খারাপ ভাবে যে নির্দ্বিধায় আমি বলি আমার পরিবার এই অনলাইন ব্যবসায় আমার পাশে ছিল না। এমনকি এখনও নেই। মেয়েরা সাধারণত সবার আগে মায়ের অনুপ্রেরণা বা উৎসাহ চায়। আমার মা কোনোদিনও কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা বা অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেননি। বরং এমন কথা বলতেন যাতে আরও উৎসাহ হারিয়ে ফেলতাম। মা কে লুকিয়েই কাজ করি বলা যায়।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিতে চাই নুশরাতের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার স্থাপত্যে যতটুকু জ্ঞান আছে তা দিয়ে একটা স্টুডিও করতে চাই। আমার শপের নিজস্ব স্টুডিও। যেখানে ক্রেতারা এসে নিজেদের পছন্দ মতো দেখে বেছে কেনাকাটা করতে পারবেন। চাকুরী করব না চাকুরী দিব- এই কথাকে গুরুত্ব দিব। মানে স্বল্পমূল্যে গয়না বানানো, আটওয়ার্ক ইত্যাদির ওপর কোর্স চালু করব।’

uddokta8

‘আমার পণ্য ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকাতে গেছে। স্বপ্ন দেখি পৃথিবীর সব দেশে আমার পণ্যের প্রসার ঘটবে। এই ছোট বৃত্তও যে মানুষের মন জয় করতে পারে আমি সেটাই করব। সঞ্চিতা একটি নামকরা ব্র্যান্ড হবে যার একটা শপ থাকবে ফ্রান্সের মতো দেশে। যার পণ্য স্থান পাবে র‍্যাম্প শো’র কোনো এক মডেলের অবয়বে বা শরীরে।’— যোগ করেন নুশরাত। 

নিজের স্বপ্ন নিয়ে এই উদ্যোক্তা নারী এগিয়ে যাক আপন শক্তি এমন কামনায় ইতি টানলাম আড্ডার। 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর