‘মইরা গেলে টাকা দিয়া কী করমু’ এমন উক্তি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের জালাল ওরফে জজ মিয়ার। দেড় যুগ আগে তিনি ফেঁসে যান গ্রেনেড হামলার মামলায়। বিএনপি-জামায়ত জোট সরকারের আমলে রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাকে। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৪ বছর বিনা দোষে জেল খেটেছেন। কারামুক্ত হয়ে হারিয়েছেন মাকে। চলে গেছেন স্ত্রী। এখনো বিয়ে হচ্ছে না ছোট বোনের। কারণ সে মামলার সাক্ষী।
জীবনে তেমন কিছু চান না, একটু কর্মের ব্যবস্থা হলেই খুশি জজ মিয়া। ক্ষতিপূরণ চেয়ে তার পক্ষে রিট করা হয়েছে হাইকোর্টে। আদালতও তার রিটে সাড়া দিয়েছে। তাকে কেন ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। এই রুলেই তিনি আশার বুক বেঁধেছেন তিনি। সরকার কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা আর চান না।
বিজ্ঞাপন
তার অভিযোগ, আওয়ামী লীগের কাছে গেলে বলে সে বিএনপির লোক। আর বিএনপি সরকারের আমলে তিনি তো মামলার আসামিই ছিলেন। জেল জীবন শেষ করে বের হন, জজ মিয়া নাম গোপন রেখে বিয়েও করেন। পরবর্তীতে জানাজানি হলে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রেখে যান ৪ বছরের শিশু। এই ৫ বছরের মেয়ে শিশুকে নিয়েই জজ মিয়ার সংসার।
আরও পড়ুন: ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে জজ মিয়ার লিগ্যাল নোটিশ
এমন বাস্তবতায় জজ মিয়ার পাশে এগিয়ে আসেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। জনস্বার্থে বিনা পয়সায় তার পক্ষে করেন রিট।
জানতে চাইলে ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব ঢাকা মেইলকে বলেন, জজ মিয়ার পক্ষে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আমরা একটি রিট আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনের শুনানি শেষে বিনা দোষে যড়যন্ত্রমূলকভাবে ৪ বছর কারাগারে রাখা ও আটকাদেশ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে বিবাদীদেরকে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, জজ মিয়ার ঘটনায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় যেহেতু একটি রায় হয়েছে, রায়ে কারা জড়িত ছিল তা উঠে এসেছে। এই মামলার আপিল বিচারাধীন রয়েছে হাইকোর্টে। ওই সময় যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের এই যড়যন্ত্রের বিষয়টি রায়ে এসেছে। ওই রায়ের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি প্রেয়ার করেছিলাম। যেহেতু এখানে একটি প্রমাণিত বিষয় তাহলে ওই ঘটনায় যারা সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা ছিলেন তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় কী না। পরে আদালত বলেছেন এ মামলা চূড়ান্তভাবে শুনানি হবে, যাদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে এ মামলায় যুক্ত করতে পারি।
তিনি বলেন, জজ মিয়া বেকার। তাকে কেউ চাকরি দেয় না। যেহেতু জজ মিয়ার সঙ্গে স্পর্শকাতর একটি বিষয় জড়িত। এসব কারণে জজ মিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আদালতের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই এমন বিষয় উল্লেখ করে জালাল উদ্দিন জজ মিয়া বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সরকার আমার কোনো ব্যবস্থা করে নাই। সরকার স্থায়ী একটা কর্মের ব্যবস্থা করে দিলে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারতাম। আমার ছোট বোনটাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারতাম। এ মামলার পেছনে আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। মাও মারা গেছেন। আমরা তিন ভাই একবোন। সবাই সবার মতো আছে। কিন্তু আমি পরিবারের কাছে দোষী।
জজ মিয়া বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিনা অপরাধে তারা আমাকে মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে মানুষিকভাবে নির্যাতন করে ক্ষতি করেছে। তখন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না দিয়ে কোনো উপায়ও ছিলনা। এজন্য জবাববন্দি দিয়েছি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে মামলা পুনরায় তদন্ত করে সত্য উৎঘাটন করেছে। আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। তারা পুনরায় তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দিছে, তাই আমি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। এ মামলায় আমি ও আমার পরিবার সাক্ষী। সরকারি মামলায় সাক্ষী হিসেবে থেকে কেন আমি এতো ক্ষতিগ্রস্থ। কেন আমি সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছি না। পালিয়ে বেড়াতে হয় আমাকে। সর্বশেষ কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছি।
আরও পড়ুন: এরপর কেউ খোঁজ নেয়নি আমার, আক্ষেপ জজ মিয়ার
তিনি বলেন, ‘আদালতের কাছে আমি ন্যায় বিচার চাই। আমার বিষয়ে জজ কোর্টের মামলার রায়ে বলা হয়েছে আপনি ক্ষতিপূরণ পাবেন। এখন আমি মইরা গিয়া ক্ষতি পূরণ দিয়া কি করব। বাইচ্যা থাইকা না পাইলে। জেলে থেকে বের হয়ে বিয়ে করছিলাম জালাল নাম দিয়ে। জজ মিয়া নাম দেই নাই। পরে জজ মিয়া নাম প্রকাশ পেলে বিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরের বছর ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়াকে ধরে আনা হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নানা ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ ও মুকুল প্রমুখ।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। এরপর তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। সেই সঙ্গে জোট সরকারের আমলে গ্রেফতার হওয়া জজ মিয়াকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সে সময় বিনা অপরাধে পাঁচ বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল তাকে।
এআইএম/এএস